রবীন্দ্রনাথের গান: শ্রাবণ, বরষা ও মেঘ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮)
ছবি: সংগৃহীত

‘এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে, এসো করো স্নান নবধারাজলে...’ গানটিতে বর্ষার নবধারাকে আহ্বান করা হয়েছে। এসব গান বাদলমুখর দিন-রাত মাতাল করে। একপ্রকার মাদকতা সৃষ্টি করে। শ্রাবণ আর রবীন্দ্রনাথ একসুরে গাঁথা। বরষার ফোঁটা পড়লেই গেয়ে উঠি: ‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে/পাগল আমার মন জেগে ওঠে/পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে/পাগল আমার মন জেগে ওঠে...’। ‘বৃষ্টি হচ্ছে’ শুনতে পেলেই কেমন যেন কৈশোর এসে গলা জড়িয়ে ধরে। ছেলেবেলা দানা বাঁধে স্মৃতিতে। বরষা কতই–না বিচিত্র! বিচিত্র কলধ্বনি সে ধারাপাতের। প্রতিটি অধোর রূপার ফোঁটার মতো বৃষ্টি-জলকে আলাদা করে চিনে নিতে হয়। সোঁদা গন্ধ, প্রকৃতির রূপ, বৃষ্টির পতনে আশ্চর্য সংগীত ধ্বনিত হয় বর্ষামঙ্গলে। আকাশপানে মেঘ জমলেই, বৃষ্টির আগাম সংকেত। মেঘ ও বৃষ্টির অনুষঙ্গ বাঙালির কাছে সবকিছু নিয়েই প্রিয়তর হয়ে ওঠে। বৃষ্টিধৌত প্রকৃতির রূপে বিমোহিত হয়। বরষা নিয়ে, মেঘ নিয়ে অসংখ্য গান লিখেছেন বিশ্বকবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ঋতুবৈচিত্র্যের ভিত্তিতে লেখা গানের সংকলন হচ্ছে ‘গীতবিতান’। ঋতুভিত্তিক গান আছে ২৮৩টি, তার মধ্যে ১১৫টি বর্ষার গান। কবি তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর...’। কখনো রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘আজ বারি ঝরে ঝরঝর ভরা বাদরে,/আকাশ-ভাঙা আকুল ধারা কোথাও না ধরে’। কবির শান্তিনিকেতনে যখন প্রথম ‘বর্ষামঙ্গল’ উৎসব হয়েছিল, তখন রবি ঠাকুর গেয়েছিলেন: ‘আজ আকাশের মনের কথা ঝরো ঝরো বাজে’। কবিগুরুর গানের বাণীতে কালজয়ী কত বরষার গান। বৃষ্টিবিলাস ও বর্ষা বন্দনায় রোমান্টিক কবি বিরহকাতরতায় যেন লিখে রাখেন, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘন ঘোর বরিষায়’। গীতবিতান-এর পাতায় পাতায় বরষা আসে সৌরভে, বরষা আসে বিরহে। এতেই বোঝা যায়, কবির প্রিয় ঋতু হচ্ছে বরষা। ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে, জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না...’জনপ্রিয় রবীন্দ্রনাথের এই গান প্রেমিকের মনে উচাটন করে তোলে; বিরহী করে তোলে। সঙ্গীর সান্নিধ্য পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী/উড়ে চলে দিগ্‌ দিগন্তের পানে/নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে/রিমঝিম রিমঝিম...’এমন গান শুনতে শুনতে আমরা নিজেকে হারিয়ে ফেলি প্রকৃতিতে, বরষায়, মেঘের মধ্যে। এমন কিছু বরষার গান তুলে ধরতেই পারি:

(১) ‘আজি শ্রাবণ ঘন গহন মোহে গোপন তব চরণ ফেলে...’।

(২) ‘হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে সেই সজল কাজল আঁখি পড়িল...’

(৩) ‘শাওনগগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথযামিনী রে, কুঞ্জপথে সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে...’।

(৪) ‘তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা, কেমন করে কাটে আমার বাদল বেলা...’।

(৫) ‘ওরে ঝড় নেমে আয়, আয় রে আমার শুকনো পাতার ডালে/এই বরষায় নবশ্যামের আগমনের
কালে...’।

কৃষ্ণচূড়ার সবুজ পাতায় লাল ফুলের আড়ালে টিয়ার বৃষ্টিস্নান, কার্নিশের জোড়া কবুতর দূর পাহাড়ের মাথায় জমতে থাকা মেঘবালিকা ঝরতে থাকে মাঠ-ঘাট-উঠানে, তখন হৃদয়ও নেচে ওঠে অজানা শিহরণে। এ আবেশ কখনো আনন্দের, কখনো বিষাদের।

রবীন্দ্রসুরে মূর্ছনা রয়েছে। কবির বরষাবিষয়ক গানগুলোতে প্রকৃতিকে মিশিয়ে দারুণ রোমান্টিসিজম সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যে ওয়ার্ডওয়ার্থ, লংফেলো, কিটস যেমন প্রকৃতিকে অবলম্বন করে রোমান্টিসিজম সৃষ্টি করেছেন, তেমনই বাঙালির রবীন্দ্রনাথ বৃষ্টি, মেঘ, বরষাকে বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে এসে দারুণ চিত্রায়িত করেছেন।

এসব গান দোলায়িত করে, অন্যলোকে হারিয়ে দেয়। রবীন্দ্রসংগীত যে কত ঋদ্ধ একটা শাখা, তা কবির গানগুলো মধ্যেই বোঝা যায়। এসব গানের প্রভাব এতই যে একবার গানের মধ্য ঢুকলেই তা প্রমাণিত হয়। রবীন্দ্রসংগীত প্রথমে দুর্বোধ্য বলে মনে হলেও একবার প্রেমে পড়লে এ গান থেকে সহজে বের হতে পারবে না কেউ। রবীন্দ্রসুরে এ অনন্যতা বিশ্বসাহিত্যেও প্রায় বিরল।

*লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক