সুইজারল্যান্ডের সহযাত্রী
বাইরে হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে জমে প্রায় ফ্রিজ হয়ে গেছি। অবশেষে বাস আসে। পাসপোর্ট ও টিকিট চেক করার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করি। বাসের মধ্যে ডিসপ্লেতে দেখাচ্ছে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা, তাতেই বেশ উষ্ণ মনে হচ্ছে।
আশপাশে তাকিয়ে নিজের সিটে ধপাস করে বসি। আগে থেকেই জানালার পাশের সিটে একজন বসে আছে, মুখমণ্ডল মানকি টুপিতে ঢাকা। আমার সেখানে বসাতে তাঁর মধ্যে কোনোই পরিবর্তন নেই। একবার তাকিয়ে দেখার প্রয়োজনও মনে করল না।
আমি কৌতূহলী হয়ে সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁকা চোখে একপলক দেখার চেষ্টা করি, সোনালি একগুচ্ছ চুল ছাড়া কিছু দেখতে পাই না। অবাক হই এই ভেবে যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমার সহযাত্রী একজন নারী!
বাস চলতে শুরু করে। ফ্লিক্স বাসে সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেল থেকে জার্মানির কার্লসুহর যাচ্ছি। একে তো বাস লেট, তার ওপর তীব্র শীত আর কনকনে বাতাসে অবস্থা কাহিল। বাসের ভেতরের তাপমাত্রা সহনীয় হওয়ায় বেশ ভালো লাগে। কাঁচুমাচু হয়ে সিটে হেলান দিতে না দিতেই চোখে তন্দ্রা নেমে আসে।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতেই দেখি, বাস থেমে আছে। বুঝতে পারি পরবর্তী স্টপেজ। চালক একে একে পাসপোর্ট আর টিকিটের কোড স্ক্যান করে যাত্রী ওঠাচ্ছে। আমার সহযাত্রী তখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এমন সময় টিকিট হাতে ২১-২২ বছরের একটা ছেলে হন্তদন্ত হয়ে জানালার পাশের সিটের দিকে ইশারা করে বলে, ‘সিটটা আমার।’ স্বর্ণকেশী ধুচমুচ করে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে সামলে নেয়।
ছেলেটি আবার বিনয়ের সঙ্গে বলে, ‘সিটটা আমার।’
‘ঠিক আছে আপনি বসেন’, বলেই মেয়েটি হাতব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এতক্ষণে বিদেশিনীকে ভালো করে দেখলাম। বিষণ্ন চেহারা শীতের রুক্ষতায় আরও মলিন হয়ে গেছে। ঘুমে টলমল চোখ দেখে বড্ড মায়া হয় আমার। কিছু না ভেবেই ছেলেটিকে বলি, ‘উনি জানালার পাশে থাকুক, তুমি বরং আমার সিটে বসো।’ আমি অন্য একটা সিটে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে যাই। মেয়েটি আমার মুখের দিকে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। ‘ঠিক আছে, তোমরা এখানেই থাকো’ বলে ছেলেটা মুচকি হেসে পেছনে চলে যায়।
সে ভেবেছে, মেয়েটি আমার পরিচিত এবং আমাদের মধ্যে ইয়ে আছে!
আমার সহযাত্রী আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে বসে পড়ে। একটু পরে পাশ ফিরে দেখি, সে জানালা দিয়ে চাঁদের দিকে উদাসভাবে তাকিয়ে আছে। বাস চলছে। সুইজারল্যান্ডের আলো-আঁধারির প্রকৃতির ভেতর দিয়ে চাঁদও সমান্তরালে ছুটে চলছে আমাদের সঙ্গে।
সুইস ঘড়ি, মানুষ ও তাদের জীবনধারা সব সময়ই আমাকে আকৃষ্ট করে। সারা দিন হেঁটে হেঁটে ব্যাসেল শহরটা দেখেছি। রাইন নদীর তীরে বসে থেকেছি। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ দুটি ওষুধ কোম্পানি রস ও নোভারটিস এই ব্যাসেলে অবস্থিত। ওষুধ কোম্পানিতে জব করার সুবাদে ব্যাসেলের গুরুত্ব আমার কাছে একটু বেশি। বাংলাদেশ প্রচুর রেফারেন্স ড্রাগ ক্রয় করে এই দুটি কোম্পানি থেকে। এ ছাড়া দেখেছি সখের সুইস ঘড়ি। স্বল্প দামে সুইস মিলিটারি ব্র্যান্ডের একটা ঘড়িও কিনেছি! ক্লান্ত পরিশ্রান্ত আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে। লম্বা একটা ঘুমের জন্য বাসের সিটে গা এলিয়ে দিই।
এমন সময় স্বর্ণকেশী আমার দিকে একটা চকলেট বাড়িয়ে ধরে। আমি থতমত খেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে হাত বাড়াই। মনের অজান্তেই অজ্ঞান পার্টির ভয় মাথায় আসে। ঢাকায় এ ধরনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। একটা কথা আছে না, ঘরপোড়া গরু সিঁদুর রঙের মেঘ দেখলেও ভয় পায়। আমার সে রকম অবস্থা, অবশ্য পরক্ষণেই সংবিৎ ফিরে পাই, এটা তো ঢাকা নয়, সুইজারল্যান্ড!
চকলেট খেতে খেতে পরিচয় পর্ব শেষ হয়। মিল এটুকুই যে দুজনেই ফার্মাসিউটিক্যালে জব করি। সেটা নিয়ে টুকটাক কথা বলতে বলতে জড়তা কেটে যায়। তারপর আমাদের মধ্যে এমনভাবে কথা চলতে থাকে, যেন অনেক বছর পর হঠাৎ পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে। এক বন্ধু অন্য বন্ধুর সঙ্গে দুঃখ–বেদনা শেয়ার করছে। আমি তার কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে থাকি। এ রকম শ্রোতা পেয়ে সে আপন মনে বলতে থাকে তার কথা।
সুইস বাবা আর জার্মান মায়ের ঘরে তার জন্ম। জার্মানিতে জন্ম হয়েছে, তবে বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা সুইজারল্যান্ডে। বাবার সঙ্গে তেমন সম্পর্ক নেই। এখন রস ফার্মাতে কাজ করে। কিছুদিন আগে জানতে পারে, বয়ফ্রেন্ড তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছে। অতঃপর বিচ্ছেদ! গত সপ্তাহে মা মারা যায়। বলতে বলতে চোখ ছলছল করে, কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে। জানালা দিয়ে উদাসভাবে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
বাস আবার থামে। এটা সুইজারল্যান্ড-জার্মান সীমান্ত চেকিং। পুলিশ এসে আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে যায়। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, ‘কোথায় যাবে?’
সে স্পষ্ট ইংরেজিতে বলে, ‘এখন প্রাগে যাচ্ছি। সেখানে দুদিন থাকব।’
জিজ্ঞেস করি, ‘তারপর?’
‘সেখান থেকে প্যারিসে যাব। ল্যুভরে উন্মুক্ত প্রদর্শনী চলছে। প্যারিস থেকে ভিয়েনা।’
আমি মাথা ঝাঁকাই।
সে আবার বলে, ‘ল্যুভরে মোনালিসাসহ বিভিন্ন চিত্রকর্ম দেখব।’
‘আগে দেখোনি?’ পাল্টা প্রশ্ন করি।
‘হ্যাঁ, দেখেছি আম্মার সঙ্গে। এবার সময় নিয়ে ভালো করে দেখব। তুমি যাবে?’
এমন প্রশ্নে আমি হতবাক হয়ে যাই। উত্তর খুঁজে পাই না। এমন সঙ্গীর সঙ্গে নরকেও যাওয়া যায়! মোনালিসাকে দেখার আমন্ত্রণে আমি শিহরিত হই। ঠিক তখনই পুলিশ এসে আমাদের পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেয়। আমি পাসপোর্ট দেখিয়ে বলি, ‘আগামী পরশু আমার ভিসার মেয়াদ শেষ!’
বাস চলতে থাকে। সহযাত্রী আবার খাবার বের করে। কেকজাতীয় খাবার ও জুস। একসঙ্গে খাবার খাচ্ছি, গল্প করছি দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা। কয়েক ঘণ্টা আগেও যাকে চিনতাম না, তাকে এখন ভীষণ পরিচিত ও আপন মনে হচ্ছে। আবার কয়েক ঘণ্টা পরেই সে হারিয়ে যাবে। ক্ষণিকের আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে যাই। ইস, এই পথ যদি শেষ না হতো, আর কয়েকটি দিনের জন্য যদি ভিসা থাকত!
পৃথিবীর অন্যতম সভ্য দেশের মাটিতে সেখানকার এক আধুনিক তরুণীর কথা শুনে চিন্তা করি। স্থান-কাল–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে মানুষের আবেগ এক এবং অভিন্ন। কষ্টে সবারই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, আবার আনন্দে সবারই ঠোঁটের কোণে খুশির ঝিলিক দিয়ে ওঠে। পৃথিবীর সব মানুষই মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ।
শতাধিক কিলোমিটার স্পিডে বাস চলছে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। ক্লান্ত চাঁদ পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। আমাদের কথা চলতে থাকে, শেষ হয় না।
অবশেষে বাস আমার গন্তব্য জার্মানির কার্লসুহর থামে। আমি বাস থেকে নামার জন্য দাঁড়াতেই সে আমার সঙ্গে দাঁড়ায়। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে আসে বিদায় জানানোর জন্য। অতঃপর মুসাফা করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। আমিও হাত বাড়াই। মুসাবা করেই পা চালাই হোটেলের দিকে। পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সে তাকিয়ে আছে। তীব্র শীত আর কনকনে বাতাসেও বুকের ভেতর একধরনের উষ্ণতার সৃষ্টি হয়। সে উষ্ণতা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে যায় পুরো শরীরে।
রুপক রেজা, মিরপুর, ঢাকা