আমার দেখা বুড়িগঙ্গা নদীর করুণ দৃশ্য

বুড়িগঙ্গা নদী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী স্রোতস্বিনী। নদীটির গড় গভীরতা ও  প্রশস্ততা যথাক্রমে ১০০ মিটার এবং ৪০০ মিটার এবং মোট দৈঘ্য ২৭ কিলোমিটার।

অতীতে মুঘল সুবেদাররা এই নদীটির জোয়ার-ভাটার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতেন। মুগল সুবেদার মুকাররম খাঁর আমলে বুড়িগঙ্গা নদীর সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়। নদীর পাড়ে আলোকসজ্জায় সজ্জিত স্থান গড়ে ওঠে। পারাপারের জন্য ডিঙি নৌকার প্রচলন বৃদ্ধি পায়। ‘ফানুস’ দ্বারা নৌকাগুলো সৌন্দর্যমণ্ডিত করা হয়, এরকম দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য মানুষকে মুগ্ধ করত।

বর্তমানে বুড়িগঙ্গা নদীর দৃশ্য একেবারেই ভিন্ন। নদীটিতে ঢাকা শহরের সব ময়লা-আর্বজনা নিষ্ঠুরভাবে ফেলা হয়। শুষ্ক মৌসুমে পানি কালো কুচকুচে হয়, আর দুর্গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। দিনের পর দিন বিষাক্ত বর্জ্যপদার্থ নীরবে ভক্ষণ করে, নদীর পাড় দখলে নিয়ে আজকে এই নদী তার জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে। পানি এত বেশি দূষিত হয়েছে, এখানে দেশি প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। শত চেষ্টা করেও মিলে না দেশি মাছের সন্ধান।

একধরনের ধারালো দাঁতযুক্ত ও আগ্রাসী প্রকৃতির ‘সাকার মাছ’ বুড়িগঙ্গা নদীতে এখন ভরপুর। জলের মধ্যে অল্প অক্সিজেনে মাছটি বিস্ময়করভাবে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে। পানি ব্যতীত ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। আগ্রাসী হওয়ায় মাছটি নদীর অন্যন্য ছোট ছোট প্রজাতির মাছের জন্য হুমকিস্বরূপ।

সদরঘাটের কাছেই বাবু বাজার ব্রিজ রয়েছে। ঢাকার তাড়িবাজার থেকে শুরু করে বুড়িগঙ্গার নদীর ওপর দিয়ে কদমতলি পর্যন্ত চার লেনের একটি ওভারব্রিজ রয়েছে। দৈনিক হাজার হাজার যানবাহন ব্রিজটির মাধ্যমে যাতায়াত করে থাকে। অসংখ্য মানুষ হেঁটেই ব্রিজটির মাধ্যমে পারাপার হয়। কেউ ভ্যানে আবার কেউ লোকাল বাসে পারাপার হয়।

ব্রিজটির নিচে বাবু বাজারের নিকটে নদীর তীরে একটি ঘাট আছে। ঘাটটি ‘ব্রিজঘাট’ নামে পরিচিত। নদীটির পাড় ঘেঁষে এরকম আরও অনেকগুলো ঘাট রয়েছে। যেগুলোতে অসংখ্য নৌকা নিয়ে মাঝিরা মানুষ পারাপারে ব্যস্ত সময় পার করে। ‘ব্রিজঘাটে’ ত্রিশ থেকে চল্লিশটি নৌকা নিয়ে মাঝিরা সারা দিন সিরিয়াল দিয়ে থাকেন। পাঁচজন করে যাত্রী পূর্ণ হলে, নদী পার হওয়ার জন্য যাত্রা আরম্ভ করে। প্রতিজন যাত্রীর কাছ থেকে ১০ টাকা করে ভাড়া নেওয়া হয়।

একটি কোচিং সেন্টারে পড়ানোর সুবাদে সপ্তাহে তিন দিন আমাকে নদী পারাপার হতে হয়। সন্ধ্যা ৭.৩০–এর দিকে কোচিং থেকে ফেরার পথে বুড়িগঙ্গা নদীটির তীর ঘেঁষে রাস্তার এক প্রান্ত দিয়ে শীতলঠান্ডা পবনের মধ্যে হেঁটে আসি ব্রিজঘাট পর্যন্ত। ব্রিজঘাটে এসে নৌকায় বসে থাকতে হয়, যতক্ষণ না পাঁচজন যাত্রী পূর্ণ হয়। এ সময়ে নৌকার মাঝিদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা মাঝেমাঝেই প্রত্যক্ষ করি, মাঝিরা প্রতিদিন যাত্রীদের অপেক্ষায়, শীতের কনকনে ঠান্ডা বাতাসে তিক্ত কষ্ট সহ্য করেন। সারা দিনের কর্মশেষে ক্লান্ত দেহ নিয়ে ছাউনি তোলা ছোট্ট নীড়ে ফেরেন। ছাউনি তোলা এই ছোট্ট নীড়গুলো নদীর তীরে সাময়িকভাবে তৈরি করেন। কেউ আবার নৌকার ভেতর বিছানা তৈরি করে রাত্রিযাপন করেন। শীতের তীব্রতা লাঘব করতে খড়কুটায় আগুন জ্বালিয়ে শরীর উষ্ণ রাখার প্রাকৃতিক পন্থা অবলম্বন করেন। দারিদ্র্যের কঠিন কষাঘাতে সহ্য করে সংসারে প্রতিটি মানুষের কথা চিন্তা করে, অসহায় এ মানুষগুলো সস্তা কিছু উষ্ণ পোশাক আর কাঁথা গায়ে দিয়ে সংগ্রাম করে প্রতিটি মাঝি রাত্রি অতিক্রম করে।

যাহোক, এগুলো পর্যবেক্ষণ করতে করতে, ১০–১৫ মিনিট পর, যাত্রীরা নৌকায় আসতে থাকে, মোট ৫ জন যাত্রী হওয়ায় পর, ব্রিজঘাট থেকে অপর দিকে ‘ওয়াইজ ঘাটে’ নৌকা ছেড়ে দেয়। নদী পারাপারের সময় দেখি, কালো পিপীলিকার মতো দূরে এবং কাছে ডিঙি নৌকাগুলো একটার পর একটা নদী পারাপার হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ‘শ্যালো নৌকা’ কাছ দিয়ে দ্রুত গতিতে চলে যায়। এ সময়ে প্রচণ্ড শব্দে বুড়িগঙ্গা নদী মুখরিত থাকে।

নৌকা যখন মাঝপথ পেরিয়ে অপর প্রান্তে নদীর কিনারায় চলে আসে, ‘ওটি আল মামুন প্লাস’ নামক বিশাল দেহের জাহাজের কাছ দিয়ে অতি সন্তর্পণে আমাদের নৌকা তখন সামনে দিকে চলে। নৌকা থেকে চোখ সোজা সদরঘাট দিকে যায়। মাঝেমধ্যে দেখি, সেখান থেকে সুন্দরবন-৪ লঞ্চটি গন্তবের উদ্দেশ্যে রওনার দিচ্ছে। বিশাল বিশাল লঞ্চের সারি থেকে লঞ্চটি বিচ্ছিন্ন হওয়া সময় সর্তক সাইরেন দিচ্ছে, আর ছোট ছোট ডিঙি নৌকা আর শ্যালো নৌকা সাবধান হয়ে যাচ্ছে।

এরপর ধীরে ধীরে ঘাটের দিকে অগ্রসর হই আর দেখতে পাই, অনেকগুলো ডিঙি নৌকা আগে থেকেই সারি বেঁধে আছে। ঘাটে নৌকা এসে থেমে গেলে যাত্রীরা মাঝিকে টাকা দিয়ে যার যার মতো করে সাবধানে নেমে পড়ি। উল্টো দিক থেকে দেখি ‘বিনা স্মৃতি স্নান ঘাটে’ থেকে মানুষের ঢল ছুটে আসছে আমাদের দিকে। মানুষের ভিড়ের মধ্যে মাঝেমধ্যে নেমে একটু চারপাশটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করি। দেখি, নৌকার মাঝিরা ডাকছে ‘এই যে এদিকে ব্রিজ ঘাট,  ব্রিজঘাট।’ কোনো মাঝি বলেন,  ‘নৌকা বরাবর যাবে, এদিকে আসেন।’ নদীতে অসংখ্য নৌকা ঢেউয়ের মতো করে ঘাটের দিকে ছুটে আসে। নদীর মাঝখানে, বড় বড় লঞ্চ প্রচণ্ড শব্দ করে পানিকে তীব্র আঘাত প্রদান করে ছুটে চলে। মাঝেমধ্যে তীব্র সাইরেন দেয়, যাতে সামনে থাকা ডিঙি নৌকাগুলো সর্তক অবস্থান নিতে পারে।

এরপর চোখ যায়, নদীর এক পাশের মার্কেটের দোকানের দিকে। রাতে সারি সারি সেই দোকান থেকে জমকালো আলো পানিতে পড়ে ঝলমল করে।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর চলে গিয়ে থাকি। ‘বিনা স্মৃতি স্নান ঘাটে’ মানুষের থেকে টোল আদায় করা হয়। স্টুডেন্ট থেকে টোল নেওয়া হয় না। তাই আমিও এই ঘাটের কোনো পয়সা প্রদান করি না। ঘাট থেকে বের হয়ে, রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে দূর থেকে দেখি, নদী কালো কুচকুচে পানিতে অসংখ্য কালো ডিঙি নৌকা আসা–যাওয়ার দৃশ্য।
শেষবারের মতো নদীটির দৃশ্য যখন অবলোকন করে চলে যেতে থাকি, তখন মনের ভেতর এই বাণীগুলো উদয় হতে থাকে।

চাইলে মানুষ কয়েকটা মিল-ফ্যাক্টরি, কালকারখানা তৈরি করতে পারবে। কিন্তু একটা নদী তৈরি করা সহজ না। প্রাকৃতিকভাবেই নদীর সৃষ্টি হয়। তাই নদী দখল করা বন্ধ করে, যত্ন নিয়ে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কলকারখানার বর্জ্যপদার্থ থেকে এই প্রাকৃতিক আশীর্বাদ বুড়িগঙ্গা নদীকে মুক্ত রাখবে হবে। তা না হলে হয়তো নদীর সঙ্গে মানুষের নিষ্ঠুর আচরণের কারণে ধীরে ধীরে নদীটি আরও সংকটের মুখে পড়বে।

*লেখক: মো. সাব্বির হোসেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়