একটু নেক নজর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

গতকাল প্রবেশপত্র দেওয়ার পর দুজন ছেলে এল। দুজনই আমার জুনিয়র। একজনের নাম তন্ময়, আরেকজনের নামটা এ মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। দুজনেই আমাকে প্রচণ্ড রকম ভালোবাসে। তাদের ভালোবাসার একটা চিত্র তুলে ধরলাম।
‘বড় ভাই, ভালো আছেন নি ক্যান? ছোট ভাইদের তো খোঁজখবর নেন না। তাই আমরাই আসলাম আপনার কাছে। এই শিমুল, মিষ্টির প্যাকেটটা দে। ভাই, সামনে তো পরীক্ষা। খুশির সংবাদ তাই মিষ্টিমুখ করাতে আসলাম।’

পরীক্ষা মানে তো দুঃখের সংবাদ। এতে খুশি হওয়ার কী আছে। আর মিষ্টিই-বা কেন?
ভাই, বেয়াদবি নিয়েন না, আপনের কাছে আসলে তো আর খালি হাতে আসা যায় না, তাই সামান্য আর কি। এক-দুইটা মুখে দিয়েই দেখেন।

প্যাকেট খুললাম। প্যাকেটের গায়ে লেখা ‘রসিক লালের মিষ্টি, খেয়ে বাড়ান দৃষ্টি।’
একসঙ্গে দুইটা মুখে পুরে বললাম, নাহ্‌, মিষ্টি ঠিক আছে।
কেজি কত করে নিয়েছে?
ভাই, দামের কথা কইয়ে লজ্জা দিয়েন না।
ভাইজানের আসন নম্বর জানি কত?
তোমরা তো আগে থেকেই সবকিছু জেনেই আসছ।
তারপরও একটা ব্যাপার-স্যাপার আছে না, কি কস শিমুল?
আসন নম্বর ৭১।
ভাই রে ভাই, আমাদের একদম কাছাকাছি পাশাপাশি সিট পড়ছে। কী যে খুশি লাগতাছে। বলার ভাষা নাই।
তাই নাকি?
জি ভাই।
ভাইজানের কি হার্ডবোর্ড আছে?
নাহ্‌।
কলম?
নাহ্‌।
পেনসিল?
নাহ্‌।
স্কেল?
নাহ্‌, আমার কিচ্ছু নাই।
খুব ভালো হয়েছে ভাই। আপনার কিছুই থাকার দরকার নাই। খালি আপনে থাকলেই হইব।
কাহিনি কী, এত প্যাঁচাইতাছো ক্যান, আসল কথা খুইলে কও।

বড় ভাই, দুই দিন পর থেকে তো পরীক্ষা। আপনে তো ভালো করেই জানেন। আপনে যেহেতু আশপাশে আছেন। একটু আপনের নেক নজর নিতে আসলাম আর কি। আজকাল বড় বুড়োদের নেক নজরের বড্ড প্রয়োজন আমাদের।

‘না রে ভাই, আমি আর আগের মতো নাই। এখন ভালো হয়ে গেছি। পরীক্ষার সময় অযথা সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। তা ছাড়া সময়েরও একটা মূল্য আছে, তাই না?
ভাই, ছোট ভাই–ব্রাদার থাকতে সময়ের মূল্য নিয়ে আপনের আলাদা টেনশন করতে হবে না। টেনশন করার জন্য আমরা তো আছি। খালি একটু আপনের নেক নজর চাই। আর কিছু না।

ভাইজান একটু চোখটা অফ করেন। ডান হাতটা দেন। সামান্য উপহার আনছি। এবার চোখটা খুলে দ্যাখেন।
খুশি হয়ে বললাম, আমি ভালো হয়ে গেছি। তোমরা এখনো ভালো হইলা না। তোমাদের নিয়ে কী যে করি।
ভাইজান, কিছু করতে হবে না, খালি একটু নেক নজর দিয়েন। না করবেন না ভাই, না করে ছোট ভাইদের আরও ছোট কইরেন না। মনে বেজাই কষ্ট আমাদের। ভাই, গুনে দেখেন ঠিক আছে কি না।
আহ্‌...হা, তোমরা না, কী যে করো। তোমাদের কষ্টের কথা শুনলে আমি ইমোশনাল হয়ে যাই। মুখে হাজারো ‘না’ করি, কিন্তু তোমাদের নিষ্পাপ চাহনি দেখলে আর ‘না’ করতে পারি না। আচ্ছা যা-ই হোক, এত করে যখন বলতাছো, তখন আর না করা যায় না। মানবতার খাতিরেও তো একটু-আধটু করতে হয়।
তয় সামনে থেকে কিন্তু ‘না’ করব। মনে রাইখো।
বড় ভাই কী রাগ করে কইলেন? শিমুল, ভাইজানরে খুশি করে দে।
আরে না না, থাক। ট্যাকাই তো সব না, তোমাদের সঙ্গে আমার যে হৃদ্যতা আছে। এটাই সব। টাকা আজ আছে কাল নাও থাকতে পারে, ভালোবাসা কিন্তু ঠিকই থাকব।
ভাই, আপনের সব কথাই কিন্তু লজিক আছে।

পরীক্ষার সময় হেল্প করা যদিও ছাইড়ে দিছি। তারপরও তোমরা কাছের মানুষ। একটু-আধটু হেল্প না করলে ব্যাপারটা কেমন দেখায়, তাই না? কিন্তু বিকেলে খালি...
আমার কথা শেষ না হতেই মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে শিমুল বলল, আরে ভাই, আপনের খিদে লাগে, এটা আমরা কি জানি না? আমাদের আলাদা করে কওন লাগব? ওইটারও ব্যবস্থা কইরে রাখছি। প্রতিদিন বিকেলে ৯ ইঞ্চি পিৎজা আসবে আপনার কামরায়। সঙ্গে থাকবে চা। ভাই, চায়ে কি চিনি আগের মতো দুই চামচ দিমু? নাকি আরও বাড়ামু?

নাহ্‌, চিনি বাড়িয়ে শরবত বানিয়ে লাভ নাই। দেড় চামচ দিয়ো। শরীরের কন্ডিশন বেশি একটা সুবিধার না। ডায়াবেটিস আসা-যাওয়া করতাছে। তোমরা তো আমার জন্য দুআ টুআ করো না।

কী যে কন না ভাই, আপনের জন্য দুআ করব না তো কার জন্য করব। বিশ্বাস করেন ভাই, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত পড়তে না পারলেও দুআটা আপনার জন্য নিয়মিতই করি। এই যে দ্যাখেন, তসবিহ থেকে এখনো বাতি জ্বলতাছে। ওদের অতিভক্তি দেখে আমি আনন্দে কেঁদে ফেললাম।

কে বলছে অতিভক্তি চোরের লক্ষণ? আমার কাছে তো এখন মনে হচ্ছে, অতিভক্তি আনন্দের লক্ষণ!