নতুন জাতীয়কৃত কলেজে চরম শিক্ষকসংকট

ছবি: প্রতীকী ছবি

২০১৬ সালে দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি কলেজকে সরকারীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রথমে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর মাউশির আঞ্চলিক কর্মকর্তারা এসব কলেজের কাগজপত্র সরেজমিনে যাচাই করেন। এরপর মাউশি ঢাকা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় পর্যায়ক্রমে আরও দুই দফা যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করে। একই বছরের ১২ আগস্ট একযোগে ২৭১টি কলেজ সরকারীকরণের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, যা কার্যকর ধরা হয় ৮ আগস্ট থেকে। পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে মোট ৩২১টি কলেজ সরকারীকরণের আওতায় আসে।

বারবার যাচাই প্রক্রিয়া, করোনা মহামারি, মন্ত্রণালয়ের জনবলসংকট ও বিভিন্ন আন্দোলনের কারণে আত্তীকরণ কার্যক্রম দীর্ঘ সময়ের জন্য বিলম্বিত হয়। প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই কলেজগুলোর নামের সঙ্গে ‘সরকারি’ শব্দ যুক্ত করে সাইনবোর্ড টানানো হলেও কার্যত সেগুলো চালু রয়েছে বেসরকারি নিয়মে।

বাংলাদেশে নতুন জাতীয়কৃত কলেজগুলোতে ২০১৬ সালের পর থেকে এই পর্যন্ত নিয়োগ নিষেধাজ্ঞার কারণে শিক্ষক নিয়োগ বা পদায়ন বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘ ৯ বছর অতিক্রম করার পরও অধিকাংশ কলেজে নিয়োগ সম্পন্ন হলেও অনেক পদ এখনো শূন্য পড়ে আছে। নিয়োগে নিষেধাজ্ঞার কারণে বহু কলেজে প্রায় অর্ধেক শিক্ষক পদ খালি হয়ে গেছে। ক্ষেত্র বিশেষ কিছু কলেজে ক্যাডার অধ্যক্ষ নিয়োগ দিলেও আজ ও কোনো শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। ইতিমধ্যে অনেকে অবসরে চলে গেছেন বা কেউ কেউ মারা গেছেন। এতে কলেজ শিক্ষকশূন্য হয়েছে; কিন্তু নতুন কেউ আসেননি। এমনও দেখা গেছে, সাবজেক্ট আছে কিন্তু সেই বিষয়ের শিক্ষক নেই। একখন প্রশ্ন হলো, সেই বিষয়ে পাঠদান কে করবেন?

এমতাবস্থাতে কলেজে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, যার কোনো সমাধান হচ্ছে না। ফলে খণ্ডকালীন শিক্ষকের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে, যা পাঠদান কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত টিউশন বা কোচিংয়ের খরচ বহন করতে না পারায় চরম সমস্যার মুখে পড়ছে। কিছু কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া গেলেও অনেক কলেজে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের সদিচ্ছার অভাবে সেটাও করা হচ্ছে না। অনেক কলেজে অনার্স চালু থাকলেও যেখানে থাকার কথা ৭ জন, সেখানে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ২ থেকে ৩ জন; যা নিতান্তই অপ্রতুল। এতে শিক্ষার্থীরা ক্লাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অনেক ক্লাস হয় না। পুরো বাংলাদেশের ৩২১টি কলেজের একই চিত্র।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর সরকারি ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়টি উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত। এই কলেজটি ২০১৬ সালে জাতীয়করণ হয় এবং বর্তমানে এখানে প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। তবে এত সংখ্যক শিক্ষার্থী ম্যানেজ করার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। কলেজে মোট চারটি স্তর রয়েছে—উচ্চমাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক (বিএমটি), ডিগ্রি ও অনার্স। এখানে পাঁচটি বিভাগে অনার্স কোর্স চালু রয়েছে।

এ বিদ্যাপীঠে শিক্ষা কার্যক্রম গুরুতরভাবে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষকসংকটের কারণে। ৫৫টি শিক্ষক-কর্মচারীর পদ থাকলেও বর্তমানে কলেজে কর্মরত আছেন মাত্র ২০ জন শিক্ষক ও ৬ জন কর্মচারী। খণ্ডকালীন কর্মচারী কিছু থাকলেও খণ্ডকালীন শিক্ষক একজন ও নেই। ফলে কলেজের বিভিন্ন বিভাগের পাঠদান সমস্যা হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থী আছে প্রায় ৫ হাজার। এতে প্রতিটি বিভাগে ২৫০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে এক শিক্ষক থাকছেন, যা পাঠদান কার্যক্রমে বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

যে বিষয়গুলোর কোনো শিক্ষক নেই, এমনকি পুরো কলেজে কোনো বিষয়ে ১ জন খণ্ডকালীন শিক্ষকও নেই। যেমন পরিসংখ্যান, অর্থনীতি, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও বিপণন, মার্কেটিং, কৃষিশিক্ষা, জীববিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, দর্শনের মতো বিষয়ে শিক্ষক নেই। তাহলে এই ক্লাসগুলোর শিখনঘাটতি কীভাবে পূরণ হবে? কোনো বিষয়ে দুই থেকে তিনজন শিক্ষকের পদ থাকলেও অবসরজনিত একজন বা কোনোটিতে একদমই নেই। যেমন ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনার্স চালু আছে ২০১৬ সাল থেকে; কিন্তু শিক্ষক আছেন মাত্র দুজন। হিসাববিজ্ঞান বিভাগে আছেন মাত্র ৩ জন শিক্ষক। একইভাবে বাংলাদেশের একমাত্র বেসরকারি কলেজ হিসেবে এই কলেজে বোটানি বিভাগে অনার্স চালু হয়; কিন্তু বর্তমানে শিক্ষক মাত্র ২ জন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগেও শিক্ষক ২ জন আর বাংলা বিভাগে ৩ জন শিক্ষক দিয়ে জোড়াতালির ক্লাস চলছে। শিক্ষকদের ওপর রয়েছে ক্লাসের বাড়তি চাপ আর শিক্ষার্থীরা ক্লাস বঞ্চিত হচ্ছে।

এভাবে আর কত দিন জোড়াতালি দিয়ে উপজেলা সদরের মতো স্বনামধন্য কলেজগুলোর নীরব কান্না শেষ হবে? পুরোনো সেই রূপ–রং–জৌলুশ ফিরে পাবে? যেখানে থাকবে শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের এক আনন্দঘন মিলনমেলা, আত্মার মেলবন্ধন। শিক্ষার্থীরা তাদের তৃষ্ণার্ত হৃদয় নিয়ে আসবে আর শিক্ষাগুরুরা এই জ্ঞান পিপাসা মেটাবেন। এইচএসসি প্রথম বর্ষ মানে ১৭–১৮ বছর বয়স, এক অন্য রকম অনুভূতি, জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের শুরু, সেখানেই যদি শিক্ষার্থীরা ক্লাস না পেয়ে হোঁচট খায়, তাহলে পুরো শিক্ষাবর্ষ কীভাবে কাটবে? এই সমস্যাগুলোর আশু সমাধান করা দরকার। অনেক কলেজে ক্যাডার অধ্যক্ষ নিয়োগ হয়েছে। সেই সুবাদে অতি তাড়াতাড়ি আমাদের নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষকসংকট নিরসন অতি জরুরি।

এ ছাড়া অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও অফিস সহকারীর অবসরের ফলে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডও জটিলতায় পড়েছে।

*লেখক: ফয়সাল হাবিব, প্রভাষক, বাঞ্ছারামপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজ, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া