ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির গণিত ও বিজ্ঞান বই পড়ে যা পেলাম

অনেক উৎসাহ নিয়ে, উৎসুক হয়ে ২০২৩ সালের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির গণিত ও বিজ্ঞান বইয়ে চোখ বুলালাম। তাতে আমার মনে হলো—

১. এ ধরনের বিপুল পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের আগে শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ, শিক্ষা প্রশাসনের যে ধরনের ও মাত্রায় প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি দরকার, তা সম্পন্ন না করেই নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম চালু করা হলো।

২. গণিতের নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য প্রথম বছর ন্যূনতম ৩০ দিন এবং প্রতিবছর ন্যূনতম ৩ দিন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা দরকার। বিজ্ঞানের নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য প্রথম বছর ন্যূনতম ১৫ দিন এবং প্রতিবছর ন্যূনতম ২ দিন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা দরকার।

৩. নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য অভিভাবকদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাড়িতে শিক্ষার্থীরা কীভাবে পড়াশোনা করবে, বাড়ির কাজ কীভাবে সম্পন্ন করতে পারবে, ইন্টারনেট ও অন্যান্য বই ব্যবহার করে কীভাবে নিজেকে আরও ভালো মানে উন্নীত করতে পারে, সে ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতনতা তৈরি করতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা দরকার।

আরও পড়ুন

৪. নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ কীভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে, সে বিষয়ে শিক্ষা প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময় বা কর্মশালার ব্যবস্থা রাখা দরকার।

৫. গণিত শুধু অনুধাবন ও হৃদয়ঙ্গম করার বিষয় নয়, অনুশীলন করার বিষয়। অনুশীলন ও চর্চা করার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন বাস্তব সমস্যা গণিতের মাধ্যমে সমাধান করার দক্ষতা অর্জন করতে হয়। কিন্তু নতুন পাঠ্যপুস্তক দুটিতে গণিতের বিষয়গুলো অনুধাবন ও হৃদয়ঙ্গম করার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, অনুশীলন ও চর্চা অনেকটা অবহেলা করা হয়েছে। যে মানের ও পর্যায়ের অনুশীলনী বইয়ে দেওয়া হয়েছে, তা সংশ্লিষ্ট শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত নয়।

উদাহরণস্বরূপ ষষ্ঠ শ্রেণির গণিত বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে যেসব অনুশীলনী দেওয়া হয়েছে, তা ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী, এমনকি (শিক্ষকদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি) বর্তমানে কর্মরত অনেক শিক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে যাবে, মাথার ভেতর ঢুকবে না। অন্যান্য অধ্যায়ের অনেক অনুশীলনীর (সব নয়) ব্যাপারেও এ কথা প্রযোজ্য। তাই উপযুক্ত মানের ও পর্যায়ের অনুশীলনী বৃদ্ধি করা দরকার।

৬. জ্যামিতিক উপপাদ্য ও সম্পাদ্য স্থাপত্যবিদ্যা, প্রকৌশলবিদ্যা ও কারিগরিবিদ্যার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নতুন পাঠ্যপুস্তকে কেন সেগুলো রাখা হলো না, তা বোধগম্য নয়। উপপাদ্য প্রমাণ করার মাধ্যমে গাণিতিক যুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা এবং সম্পাদ্য অঙ্কনের মাধ্যমে উপপাদ্যকে প্রয়োগ করার দক্ষতা অর্জন করা যায়। কিন্তু এ বিষয়গুলো কেন বাদ দেওয়া হলো, তা বোধগম্য নয়। উপপাদ্য প্রমাণ করার ব্যবহারিক অনুষঙ্গ কি আমাদের চারপাশে বিদ্যমান নেই? সেগুলো ব্যবহার করে উপপাদ্য প্রমাণকে কি আরও উপভোগ্য ও সহজবোধ্য করা যেত না?

আরও পড়ুন

৭. বিজ্ঞান বই দুটিতে অনেক বিষয় বা টপিক রাখা হয়েছে। কিন্তু অনেক বিষয় (সব নয়) সম্পর্কে স্পষ্ট ও পরিপূর্ণ বিবরণ দেওয়া হয়নি। অনেক টপিক দু-এক লাইনে শুধু স্পর্শ করা হয়েছে।

৮. বিজ্ঞান বই দুটিতে অনেক ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। যেমন ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ে ফুলের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচিত না করিয়েই পরাগায়ন ও নিষেকের ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ফুলের বিভিন্ন অংশের ধারণা না থাকলে পরাগায়ন ও নিষেক কীভাবে বোঝা যাবে, তা বোধগম্য নয়। ফুলের বিভিন্ন অংশের বিষয়ে বিজ্ঞান অনুশীলন বইতেও কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি।

৯. বিজ্ঞান বই দুটিতে যে মানের ও পর্যায়ের অনুশীলনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তা ওই শ্রেণির উপযুক্ত নয়। ১০ বছর আগেও যে ধরনের প্রশ্ন কলেজ পর্যায়ে করা হতো, তা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইতে রাখা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধান পাঠ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের অনুশীলনী নম্বর ৬ উল্লেখ করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীরা অজানা রাশির সমীকরণ সম্পর্কে জানতে পারবে সপ্তম শ্রেণির গণিত বইতে, কিন্তু অজানা রাশির সমীকরণ ব্যবহার করে সমস্যা সমাধানের অনুশীলনী রাখা হলো ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধান পাঠ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে। এটা কী জন্য হলো, তা বোধগম্য নয়। এতে কি শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি ভীতি ও অনীহা তৈরি হবে না?

১০. ষষ্ঠ শ্রেণির বইগুলোয় সপ্তম শ্রেণির বইগুলোর তুলনায় বেশি ও কঠিন (সব ক্ষেত্রে নয়) নতুন বিষয় রাখা হয়েছে।

১১. ভারতীয় টিভি ধারাবাহিকের পর্বগুলো কোনো ঘটনার চূড়ান্ত পর্যায়ের ঠিক মাঝখানে, চূড়ান্ত ঘটনার পরিসমাপ্তি দেখানোর আগেই শেষ করা হয়, যাতে দর্শক চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি জানতে পরের পর্ব দেখতে মুখিয়ে থাকে। নতুন বইগুলোতেও অনেক বিষয়বস্তুর আলোচনাও মাঝখানে ‘শেষ হইয়া হইল না শেষ’ পর্যায়ে শেষ করা হয়েছে।

১২. নতুন পরীক্ষামূলক বইগুলো পরবর্তী বছর পরিমার্জন করা হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মতামত ও পরামর্শকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কারণ, শিক্ষকেরাই নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। বিশেষ করে দুর্গম চরাঞ্চল, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল ও উপজেলা পর্যায়ের নির্ভয়ে সত্য বলা (সুবিধাবাদী নয় এমন) শিক্ষকদের মতামত ও পরামর্শকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার, নয়তো গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়তে পারে।

১৩. অনেক প্রকল্পের মেয়াদ ও বাজেট বাড়ানো হয়। দেশের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি টেকসই করার জন্য এবং দেশের জনমিতিক সুবিধাকে সর্বোত্তম উপায়ে কাজে লাগানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ অদৃশ্য কাঠামো হলো শিক্ষা। শিক্ষা খাতে আমূল পরিবর্তনের এই কাজের মেয়াদ, বাজেট ও প্রস্তুতি বাড়ানো খুবই জরুরি।

সবার ইতিবাচক, ঐকান্তিক, সমন্বিত ও সামগ্রিক প্রচেষ্টায় আমাদের শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ আনন্দদায়ক, স্বাচ্ছন্দ্যময় ও সফল হোক, স্থিতিশীল হোক।

লেখক: সাবেক বিজ্ঞান শিক্ষক