তোমরা তারে বলবা কী

ফাইল ছবি

কর্মক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া সত্য-মিথ্যা ভাবনাগুলো বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। উপলভ্যের জাগ্রত কিছু ভাবনা নিজেকেই প্রশ্ন করে, তোমরা তারে বলবা কী?

এক.
হাজি সাহেব পবিত্র হজ পালন করতে মক্কা গিয়েছিলেন। জেদ্দা বিমানবন্দর থেকে অতিরিক্ত ওয়েট চার্জ দিয়ে লাগেজ ছাড়াতে হয়েছিল। সোনার গয়না যা-ই কিনেছিলেন, কম্বল কিনেছিলেন ১০টা। কথাবার্তার অন্তরালে বুঝেছিলাম, তিনি একজন ধনবান হাজি। লাবণ্যতা বজায় রেখে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, হাজি সাহেব, এতগুলো কম্বল লইছেন কেন? জবাবে বলেছিলেন, নিলাম আরকি। ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে পরিজনদের ফরমাশ মেটাতেও কিছু নিয়েছি, সবই লাগবে, একটিও ফেলানো যাবে না।

পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলাম, কম্বল নিশ্চয়ই ফেলে দেওয়ার মতো জিনিস নয় হাজি সাহেব। প্রশ্ন হলো, নিজে কোরবান হতে এলেন, কোরবানি দিলেন, ফেরার সময় নিলেন ১০টা। কোরবান আর হইলেন কই? দুনিয়া দুনিয়া একটু বেশি হয়ে গেল, তাই না? হাজি সাহেবের চেহারা মলিন হয়ে এল। কী মনে করলেন বুঝতে পারিনি। আমি মনে করলাম, তোমরা তারে বলবা কী?

দুই.
বিমানবন্দরে মেডিকেল সেবায় নিয়োজিত হুইল চেয়ারের শ্রমিকেরা বিভিন্ন দেশের রোগীদের বিভিন্ন ফ্লাইটে তুলে দেন। রোগীকে বিমানের আসনে পৌঁছে দিয়ে দায়িত্বের সঙ্গে বসিয়ে দেওয়া তাঁদের প্রধান কাজ। অধিকাংশ যাত্রীই খুশি হয়ে এসব শ্রমিককে কিছু বকশিশ দিতেন। আজও দেন, দিচ্ছেন। বকশিশগুলো হতে পারে ডলার, রিয়াল বা যাত্রীদের নিজ দেশের প্রচলিত মুদ্রা। কেউ আবার শ্রমিককে সঙ্গে নিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টায় হলেও ভোজন করিয়ে ছাড়েন অথবা রিচ ফুড কিনে দেন। সে যা–ই হোক। অ্যারাবিয়ান কিছু শেখ বা ধনী লোক এসব শ্রমিককে মাঝেমধ্যে চমকে দেন। আবেগাপ্লুত মনে বলেন, আমার বাবা কিংবা মাকে এ শ্রমিক বিমানের আসন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছেন, খুশিতে আত্মহারা হয়ে পাঁচ শ কিংবা এক হাজার রিয়াল বকশিশ দিয়েছেন—এমনটাও প্রায় ঘটেছে।

সারা দিনের বেতন ৩০ রিয়াল। ভাগ্যের সায়ে একদিনেই এক মাসের বেতন পেয়ে যান, কথাটা দুরূহ হলেও মাঝেমধ্যে তা-ই সত্যি। যার অগাধ অর্থসম্পদ আছে, তাঁর জন্য পাঁচ শ বা এক হাজার রিয়াল তেমন বড় কিছু নয়। দেওয়ার মনমানসিকতা থাকলে নিশ্চয়ই দিতে পারেন। অর্থের মায়া ত্যাগ করে মনকে সেরকম ভাবে তৈরি করতে পারা কঠিন হলেও কেউ না কেউ তা অবশ্যই করছেন। তোমরা তারে বলবা কী?

তিন.
মাহমুদ নামের এক সৌদি সুপারভাইজারের মেজাজ খুবই খিটখিটে ও কর্কশ। সহজ ও সুন্দর কথাগুলোও ধমকি-ধামকি ছাড়া বলতে পারেন না। কৌশল বিনিময়ে শ্রমিকদের সঙ্গে সচরাচর হাত মেলাতে নারাজ ছিলেন। শ্রমিকেরা তার ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হলেও মনিব হিসেবে কোনো প্রতিবাদ করেতেন না। রিপোর্ট লিখে স্থান পরিবর্তন করে দিলে অথবা চাকরি চলে গেলে দৈনিক ৪০-৫০ রিয়াল বকশিশ নামের অতিরিক্ত আয় থেকে বঞ্চিত হওয়ার আতঙ্কে সবাই ক্ষান্ত থাকতেন।

এক অসুস্থতা থেকে মাহমুদের ডান হাত এবং ডান পা প্যারলাইসিসে আক্রান্ত হয়ে দৈবাৎ অকেজো হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে মেকি পায়ে কোনো রকম চলাফেরা করছেন। শিগগিরই কর্মক্ষেত্র থেকে ইস্তফার পরিকল্পনা নিয়েছেন। এ সুযোগে কিছু শ্রমিক মনের ক্ষোভ প্রকাশে অগোচরে বলতেন, আল্লাহ ঠিকই করেছে। তার হাতের দাম কত! আমরা নিম্ন শ্রেণির কর্মকর্তা বলে আমাদের সঙ্গে হাত মেলাতে চান না। হাত মেলানো বা কৌশল বিনিময়কে আরবিতে সাল্লিম বলা হয়। মাহমুদ ইদানীং অনুতপ্ত। কষ্ট হলেও বাম হাত তুলে শ্রমিকদের সঙ্গে সাল্লিমের চেষ্টা করেন। কিছু দুষ্টু শ্রমিক প্রতিদানস্বরূপ করোনার দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যান।

আমি এসব শ্রমিকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় বলেছিলাম, অবুঝের মতো এমন করে বলতে নেই। কখন, কার কী হয়, একমাত্র আল্লাহ ভালো জানেন। আমরা তা বলার ক্ষমতা রাখি না। সবশেষে নিজেকেই প্রশ্ন করি, তোমরা তারে বলবা কী?

চার.
মানুষ মানুষকে শোষণ করার পথ এড়াতে চায় না। ক্ষমতা অনুযায়ী কমবেশি শোষণ সবাই করে, করতে চায়। কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তির অপকর্ম, ক্ষুধা আর লোভ-লালসার স্বীকার হয় তার আয়ত্তের লোকগুলো। মানুষ বিচারাধীনে নিজ স্বীকারোক্তির মাধ্যমে কর্মের সব প্রতিফল মেনে নেবে। কিছু আস্থাহীন মানুষ ছাড়া এ সত্য সবাই স্বীকার করলেও পৃথিবী থেকে অত্যাচার, অবিচার ও অপকর্ম বিদায় নেয়নি। মানুষ এগুলোকে বিদায় করে দেয়নি, দিতে পারেনি। বরং এগুলোকে পৃথিবীর বুকে স্থান করে দিয়েছেন। লালন করছেন।

‘চিনি আর লবণ দেখতে এক রকম হলেও স্বাদে পার্থক্য। মানুষ আর অমানুষ দেখতে এক হলেও কাজকর্ম এবং আচরণে ভিন্ন।’
তোমরা তারে বলবা কী?

পাঁচ.
যুগের হাওয়ায় কত কী ঘটবে, জানা নেই। সুন্দরের প্রতি মানুষের তৃষ্ণা প্রবল। আমরা সুন্দর খুঁজি। নিজে সুন্দর হই না। সুন্দরের টানে নিজেকে ঠেলে দিই কদর্যে।

এক নারীর কারণে চারজনের ফাঁসি হতে দেখেছি। এক নারীর কারণে চার সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ হতেও দেখেছি। নারী-পুরুষ সাপেক্ষে ভালো মানুষ বলতে শুধুই সেলিব্রিটি, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট কিংবা বৈজ্ঞানিক সার্টিফিকেট অর্জনকে বোঝায় না। ‘একই পাতিলের ফুটন্ত গরম পানিতে রাখা ডিম হচ্ছে শক্ত, আর আলু হচ্ছে নরম।’
তোমরা তারে বলবা কী?
*মো. জিয়াউদ্দিন শাহ, পশ্চিম পান্থপথ, ঢাকা