সাহিত্য ও অস্তিত্বের সীমারখো ক্রাসনোহারকাই

একটি পোড়া ভবনের ছবি, একটি ছিন্ন পতাকা বা একটি ভাঙা দরজা কখনো মানবিক অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে ওঠে, যা ধ্বংসের মধ্যেও মানুষের টিকে থাকার প্রতিচ্ছবি। সেই প্রতিচ্ছবি সাহিত্যে শিল্পের স্থায়িত্বকে তুলে ধরেন যুগপৎ প্রলয় ও সৌন্দর্যের রূপকার লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। তিনি তাঁর আবেগপূর্ণ ও দূরদর্শী সাহিত্যে মহাপ্রলয়ের মাঝেও শিল্পের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। সে জন্য ২০২৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। এই স্বীকৃতি বিশ্বসমাজের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আসে, যখন যুদ্ধ, জলবায়ু বিপর্যয়, রাজনৈতিক বিভাজন ও নৈতিক অবক্ষয়ের ছায়া পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ৭১ বছর বয়সী ক্রাসনাহোরকাই পেশায় লেখক ও চিত্রনাট্যকার। লেখকের জন্ম ১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির গিউলা শহরে, যেখানে তাঁর শৈশব কাটে কমিউনিস্ট শাসনের ঘেরাটোপে।

ক্রাসনাহোরকাইয়ের উপন্যাসে বাস্তবতা ও কল্পনার সীমা অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। মানবজীবনে আশাকে ভবিষ্যতের অধিকার হিসেবে চিত্রিত করেছেন। জীবনে ক্লান্তির মধ্যে খুঁজে পান নিগূঢ় সৌন্দর্য, যেখানে অর্থহীনতাই হয়ে ওঠে অর্থের উৎস, পতন হয়ে ওঠে মুক্তির উপায়। মানুষ কেবল এক ঘূর্ণির মধ্যে আবর্তিত হয় বেঁচে থাকা আর ধ্বংসের মাঝখানে। তাঁর সামগ্রিক সাহিত্য মহাপ্রলয়ের আশঙ্কার মাঝেও যেন শিল্পের শক্তিকে তুলে ধরে।

প্রলয়ের ভেতর সৌন্দর্য, বিশৃঙ্খলার মধ্যে শৃঙ্খলা এবং হতাশার গভীরে শিল্পের সম্ভাবনা—এই ত্রিবিধ টানাপোড়েনেই ক্রাসনাহোরকাইয়ের সাহিত্যজীবন। মূলত মানবজীবনের অস্থিরতা, ভয়ের মনস্তত্ত্ব ও নৈতিক বিপর্যয়ের ভেতর থেকেও শিল্প ও সৌন্দর্যের জয়গান তাঁর সাহিত্যের মূল সুর। তাঁর রচনায় সভ্যতার পতন, নৈতিক অবক্ষয় ও মানবাত্মার সংকটের মধ্য দিয়ে ঘুরপাক খায়। তিনি দেখান কীভাবে মানুষ বিশৃঙ্খলা ও ভয়ের মধ্যেও বেঁচে থাকে এবং কীভাবে শিল্প ও সৌন্দর্য এই ধ্বংসের ভেতরেও টিকে থাকতে পারে। তাঁর লেখায় প্রলয়ের চিত্র যেমন আছে, তেমনি আছে পুনর্জন্ম, মুক্তি ও ঈশ্বরীয় অর্থ খোঁজার প্রচেষ্টা। তাঁর সামগ্রিক সাহিত্য মহাপ্রলয়ের আশঙ্কার মাঝেও যেন শিল্পের শক্তিকে তুলে ধরে। সে জন্যই হয়তো তিনি বলেছেন, ‘বেঁচে থাকা সুন্দর নয়। মরে যাওয়াও সুন্দর নয়। এমনকি জীবনও সুন্দর নয়। শুধু মানুষই সুন্দর।’

ক্রাসনাহোরকাইয়ের উপন্যাস ও ছোটগল্পে যুদ্ধ, প্রলয় ও সামাজিক ভাঙ্গনের মধ্যে শিল্প, সংস্কৃতি ও সৃষ্টিশীলতার সম্ভাবনা খুঁজে পাওয়া যায়। এ সমাজে নৈতিকতা ভেঙে পড়েছে, রাজনীতি নিঃস্বার্থ নয় এবং প্রযুক্তি ও ক্ষমতার মোহে মানুষ হারিয়েছে অস্তিত্ববোধ; অথচ এই পতনের মাঝেও ক্রাসনাহোরকাই বিশ্বাস করেন, শিল্প, চিন্তা ও মানবতার শক্তি এখনো টিকে আছে। এই দ্বন্দ্ব-ধ্বংস ও মুক্তি, প্রলয় ও পুনর্জন্ম তাঁর সাহিত্যকে সমাজের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত করে। এখানে ক্রাসনাহোরকাই সমাজকে দেখেন এক প্রলয়োত্তর সম্ভাবনার ক্ষেত্র হিসেবে, যেখানে সবকিছু হারিয়ে গেলেও মানুষ জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে পারে। এই ধারণা আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের স্থিতিস্থাপকতা ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। তাঁর সাহিত্য এই মানসিক স্থিতিস্থাপকতাকেই শিল্পের ভাষায় প্রকাশ করে।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

ক্রাসনাহোরকাইয়ের উপন্যাসে প্রাচীন চিত্রকলা, সংগীত বা সাহিত্য মানসিক আশ্রয় হিসেবে কাজ করে। যুদ্ধের তাণ্ডব ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মাঝে শিল্পের প্রতিরোধ হিসেবে গড়ে ওঠে। এই প্রতিরোধ কেবল সাংস্কৃতিক নয়, মানবিকও। রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় বিভিন্ন দেশের দেয়ালে আঁকা প্রতিবাদী ছবি, স্লোগান বা প্রতীক (যেমন মুষ্টিবদ্ধ হাত, পতাকা, ভাঙা শৃঙ্খল, শহীদদের মুখ, স্বাধীনতার প্রতীক ইত্যাদি) আমরা দেখতে পাই; যেগুলোর মাধ্যমে ভবিষ্যতের আশা জেগে থাকে এবং মানবজীবনের অন্ধকার মুহূর্তগুলোকে আলোকিত করার চেষ্টা করে। এ ছাড়া তাঁর রচনায় ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের শিকার মানুষ শিল্প ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে মানসিক শক্তি ধরে রাখে। এ ধারণার সাথে বাস্তব জীবনের দারিদ্র্যপীড়িত সমাজ যেমন আফ্রিকার শরণার্থীশিবির, দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র অঞ্চল বা যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরগুলোতে দেখা যায়; যেখানে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও শিল্পের মধ্য দিয়ে মানবিক শক্তিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের দর্শন লুকিয়ে আছে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বিভিন্ন দেশের অনাথ শিশুরা ছবি আঁকার মাধ্যমে নিজের কষ্ট প্রকাশ করে। পাশাপাশি ছোট ছোট আনন্দ ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানবিকতা ও শিল্পকে টিকিয়ে রাখে তারা। যেমন ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের মধ্যে ফিলিস্তিনি শিল্পীরা গাজা স্ট্রিপের ফ্রেসকো ও দেয়ালচিত্রে শিশু ও সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা ও আশা একসঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন। কিছু দেয়ালচিত্র উন্নত ভবিষ্যতের আশাকে তুলে ধরে, যেখানে লেখা থাকে কষ্টের পর স্বস্তি আসে, যা গাজার জনগণের দুর্দশার অবসান এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। এ ছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রদর্শিত ফটোগ্রাফ ও ইনস্টলেশনগুলো আমাদের শেখায় মানবিক বেদনার নান্দনিক প্রতিবাদ। তারা গান গায়, গল্প শোনে, একে অপরের জীবনে মানসিক সমর্থন জোগায়। এটি প্রমাণ করে, মানবিক সৃজনশীলতা দারিদ্র্য ও অভাবের মধ্যেও হতে পারে। এখানেই বাস্তব জীবন ও ক্রাসনাহোরকাইয়ের সাহিত্য একত্র হয়। এখানে ফটোগ্রাফের মাধ্যমে যুদ্ধের গল্প করুণ সুর নয়, বরং এক নীরব শক্তি প্রকাশ করে। এই শিল্পগুলো কেবল দুঃখ নয়, একধরনের নৈতিক পুনর্গঠনও। ধ্বংসের মাঝেও মানবতা, সহমর্মিতা আর টিকে থাকার প্রবল ইচ্ছাই এই শিল্পের মূল বিষয়। এই শিল্প কেবল সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, এটি মানবিক মুক্তির মূল শক্তি, যা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মাঝে আশার আলো খুঁজে পায়।

কখনো কখনো প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ফটোগ্রাফে গ্রাফিতি বা দেয়াল ব্যবহার করা হয়। এই ফটোগ্রাফ ও ইনস্টলেশনগুলো একধরনের মানবিক প্রতিবাদ, যা যুদ্ধের পরও নাগরিক কণ্ঠস্বরের প্রতীক হয়ে ওঠে। এ ছাড়া পুরোনো ভবনের ফটোগ্রাফ, নাগরিকদের সাক্ষাৎকার ও ভিডিও ইনস্টলেশন শহরকে এক স্মৃতির মানচিত্রে পরিণত করে। এসব স্থানে প্রদর্শিত ফটোগ্রাফ, শহরের দগদগে ক্ষত, মানুষের স্মৃতি ও নীরব প্রতিবাদ শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এখানে শিল্প হয়ে ওঠে ইতিহাস সংরক্ষণের মাধ্যম, যা ক্ষতবিক্ষত, যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরের চিত্র তোলে ধরে। আমরা এমনটা দেখতে পাই রানিয়া মতার ফটোগ্রাফে, যেখানে যুদ্ধবিধ্বস্ত ভবনে নারী ও শিশুদের চোখমুখে এক অদ্ভুত নীরব প্রতিরোধ। তানিয়া এল খৌরির কাজগুলো দেখিয়ে দেয়, পুড়ে যাওয়া স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক শিশুর ছবি, যা আমাদের চোখে শুধু দুঃখ নয়, বরং গভীর মানবিক সহনশীলতা এনে দেয়। পাশাপাশি দেয়ালজুড়ে গ্রাফিতি, ভাঙা নির্বাচনী পোস্টার কিংবা রাস্তায় ছেঁড়া পতাকা সমাজের নিস্তব্ধ প্রতিবাদকে প্রকাশ করে। এসব ক্রাসনাহোরকাইয়ের কল্পিত চরিত্রের সঙ্গে একধরনের বাস্তব সম্পর্ক স্থাপন করে।

বাস্তবে ধ্বংসের মাঝেও মানুষ তার অস্তিত্বের ছবি আঁকে। এই শিল্পগুলো কেবল শহরের ধ্বংস নয়, বরং মানুষের টিকে থাকার নান্দনিক প্রকাশ। তাঁর লেখায় যে ধীর, দীর্ঘ ও গভীর বাক্যপ্রবাহ, তা যেন সমাজের ভাঙাচোরা ছন্দের বিপরীতে একপ্রকার প্রতিরোধ। এই ধীরতা সমাজে হারিয়ে যাওয়া মনোযোগ ও ভাবনার পুনরুদ্ধার ঘটায়। তাই তাঁর নোবেল জয় শুধু সাহিত্যিক কৃতিত্ব নয়, এটি সমাজে চিন্তার সামঞ্জস্য পুনর্নির্মাণের আহ্বান। কারণ, প্রলয়ের ভেতর আমরা সৌন্দর্য ও নৈতিকতা খুঁজে পেতে পারি, যদি শিল্প ও চিন্তাশক্তিকে জীবিত রাখি।

লেখক: অনজন কুমার রায়, ব্যাংকার ও কলামিস্ট