ধন্যবাদ তামিম ইকবাল

তামিম ইকবাল
ছবি: প্রথম আলো

সময়টা তখন ১৯৯৭, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। গ্রামের মেঠো পথ ধরে ছাতা মাথায় দিয়ে প্রাইমারি স্কুলে যাওয়া–আসা করি। বাংলাদেশ তখন ক্রিকেটে ওডিআই খেলার স্বীকৃতি পেয়েছে। একটা দেশের ক্রিকেটের প্রথম দিকে যে অবস্থা হয়, সহজ কথায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে চলেছে দেশের ক্রিকেট। শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি, সাঈদ আনোয়ার, মার্ক ওয়াহ, ওয়াসিম আকরাম, ব্রায়ান লারা, সনাৎ জয়াসুরিয়া—এসব বড় বড় নাম তখন দাপটের সঙ্গে ক্রিকেট মাঠ কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ সময় কোনো ম্যাচে বাংলাদেশ যদি ১০০–এর বেশী রান অর্থাৎ ১৫০–৬০ করলে অথবা সম্মানজনক কোন পরাজয় হলেও আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলতাম। এই তো সে সময় বর্ষাকালে একটা ওডিআই ম্যাচে বর্তমান জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার আতাহার আলি খানের ৮০ রানের ইনিংস আমাদের সবার মনে বিজয়ের সমপরিমাণ আনন্দ বয়ে নিয়ে গেছে। তখন অবশ্য গ্রামে সবার ঘরে টিভি ছিল না। রেডিওতে সবাই বল বাই বল ধারাবিবরণী শুনতাম। তারপর কেনিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম ওডিআই জয় দিয়ে শুরু, শাহারিয়ার হোসেন বিদ্যুতের ৯৫ রান এবং অবশেষে মেহরাব হোসেন অপির হাত ধরে এল প্রথম শতক।

দেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি, সে এক অসাধারণ ভালো লাগার অনুভূতি। তারপর ১৯৯৯ বিশ্বকাপে টাইগারদের দারুণ পারফরম্যান্স। ক্রিকেট পরাশক্তি পাকিস্তানের বিপক্ষে অসাধারণ বিজয়। এই তো স্বপ্ন দেখার শুরু, ভালো কিছু করার। ধাপে ধাপে এল টেস্ট স্বীকৃতি। মাঝেমধ্যে অনেক দিন পরে এক একটা ম্যাচ জয়।

আমাদের আনন্দমিছিল নিয়ে রাস্তা–ঘাটে উল্লাস করে ঘুরে বেড়ানো। ২০০৫ সালে প্রথম অস্ট্রেলিয়া বধ। সবকিছু ধীর গতিতে এগুচ্ছিল। তারপরও মনের ভেতর অজানা এক আক্ষেপ। আমাদের দেশেও এমন একজন ব্যাটসম্যান একদিন আসবেন, যিনি কিনা ৫০০০, ৬০০০, ৭০০০ ওডিআই রান করবে। আসলে কি কখনো তিনি আসবেন! না কি স্বপ্ন, কল্পনা সবই অধরা রয়ে যাবে।

অবশেষে তামিম ইকবল এলেন। ২০০৭ বিশ্বকাপে পরাক্রমশালী ভারতের বিরুদ্ধে ভয়ডরহীন ক্রিকেট, যা এখনো চোখে লেগে আছে। বয়স পেরিয়ে ততদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। হলের টিভিতে অনেকের সঙ্গে তামিমের সেই খুনে মেজাজের ব্যাটিং উপভোগ করেছি, আর আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়েছি। তারপরের গল্প তো সবারই জানা। জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ১৫৮ রানের মহাকব্যিক ইনিংস। লর্ডসে সেঞ্চুরি, অনার্স বোর্ডে নাম উঠানো। এশিয়া কাপে পরপর চার মাচে চার হাফ সেঞ্চুরি করে সেই ব্যতিক্রম উদ্‌যাপন, এর মধ্যে তামিম হয়ে উঠেছেন দেশসেরা ব্যাটসম্যান, দেশসেরা ওপেনার। আর আমাদের সেই স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে পূরণও করে ফেললেন। দেশের কোন ব্যাটার ৫০০০ রান, আহা কী সুন্দর লাগতো দেখতে!  এই দিনের জন্যই তো ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতাম। আশায় বুক বাঁধতাম। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তামিম তাঁর খেলার স্টাইলে এনেছেন পরিবর্তন। শুরুর দিকে ভয়ডরহীন তামিম, এক যুগের বেশী সময় ধরে খেলেছেন ঠান্ডা মাথার ম্যাচিউর স্মার্ট ক্রিকেট। যার কারণে তাঁকে অবশ্য অনেক সময় ট্রলের শিকার হতে হয়েছে। তাতে তামিমের কি এসে–যায়। তাঁর কাজটাই তিনি করে গেছেন সুদক্ষ ব্যাটিং কারিগর হিসেবে।

তামিম, আমরা আপনাকে কখনোই ভুলবো না। এ দেশের ক্রিকেট আপনাকে কখনো ভুলবে না। ভুলতে পারে না। এশিয়া কাপে আঙুল ভেঙে যাওয়ার পরও দলের প্রয়োজনে এক হাতে আপনার সেই ভয়ংকর সুন্দর প্রতিরোধের ব্যাটিং জাতি সব সময় মনে রাখবে। এখন থেকে ৫০ বছর পরেও আপনাকে নিয়ে গল্প হবে। আমাদের এক তামিম ছিলেন যিনি কি না প্রথম ৫০০০ রান করেছিল। যিনি কিনা ১৫,০০০ রান করেছিল। যিনি কিনা ভাঙা হাতে ব্যাট ধরেছিলেন। যাঁর নাম লেখা আছে লর্ডসের অনার্স বোর্ডে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ক্রিকেটে ফিরেছেন। ক্রিকেট আপনাকে অবশ্যই মনে রাখবে, তামিম ইকবাল। আপনার জন্য শুভকামনা। সব কিছুর জন্য ধন্যবাদ তামিম ইকবাল!
*লেখক: প্রীতম মন্ডল, ব্যাংক কর্মকর্তা