কৃষ্ণচূড়ার পরশে প্রকৌশল

উত্তরের হিমেল হাওয়ার পরশে প্রকৃতিকে নতুন রূপে সাজিয়ে, শীতের রুক্ষতাকে দূরে ঠেলে হাজির হয় ঋতুরাজ বসন্ত। তবে উত্তরে ঋতুরাজের আগমনী বার্তা জানান দিতে একটু সময় লাগে, সেটা শহর পেরিয়ে প্রকৃতিতে নজর দিলেই বোঝা যায়। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গুরুগম্ভীর পড়াশোনা আর ল্যাব রিপোর্টের ভারে চোখ দুটো মেলে ঋতুর পরিবর্তন ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রদের চোখে না পড়ারই কথা।

আট মাস হয় চিরচেনা জাদুর শহরটাকে ছেড়ে পড়ে আছি দেশের সর্ব উত্তরের জেলা লালমনিরহাটের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা আর ল্যাবে কাজের চাপে কখন গ্রীষ্ম বিদায় নিয়ে র্বষা আসে, আবার বিদায় নেয় সেটাও ঠিকঠাক ঠাওরে ওঠার উপায় নেই।

তবে আমার জীবনের ১৯টি বসন্ত থেকে এবারের বসন্তটা একটু ব্যতিক্রম। জীবনের কৃত্রিমতা থেকে একটু দূরে সরে, প্রতিযোগিতাপূর্ণ দুনিয়া থেকে দূরে, প্রকৃতির কাছাকাছি। মানুষ আর প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে প্রকৃতির সঙ্গে ভাববিনিময় করতে, স্বল্প সময়ের জন্য হলেও বোরিং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া মানুষগুলোকে একটা সুযোগ করে দেয় ‘কৃষ্ণচূড়া’।

‘কৃষ্ণচূড়া’ হলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণের উৎসব, আমাদের আবেগ ভালোবাসর উৎসব। উৎসবের শুরুটাও হয় খুব নাটকীয়ভাবে। কথায় আছে, ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে রসকষ থাকে না। থাকে অ্যারোডায়নামিক থিউরি, থাকে ক্যালকুলাস। তাই চিরাচরিত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো খুব উৎসবমুখরভাবে অনুষ্ঠানে পূর্বপ্রস্তুতির সূচনা হয় না আমাদের। আমাদের কালচারাল ক্লাবের সক্রিয় হাতেগোনা কিছু মুক্তমনা মানুষের হাত ধরে পূর্ব প্রস্তুতি শুরু হয়। অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গেলে তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেন যে তাঁদের মতোই হাতেগোনা কয়েকজন মুক্তমনা মানুষ এই ইঞ্জিনিয়ারিং নামক কৃত্রিমতার জালে আটকা পড়ে গিয়েছে। তারপরও শত প্রতিকূলতা, শত বাধা পেরিয়ে তাঁরা আমাদের কিছুক্ষণের জন্য হলেও একটু মুক্তির স্বাদ দেন। রিহার্সেলের মধ্যেই চলছে কারও ক্লাস, ল্যাব অথবা পরীক্ষা। তাই নাচ, গান, অভিনয় বা অন্য কোনো সাংস্কৃতিক কাজে পুরো দলটাকে একসাথে পাওয়ার চেয়ে মায়াবী সোনার হরিণ পাওয়া মনে হয় খুব সহজ। তারপরও রিহার্সেল চলেছে। তবে রিহার্সেলের সময় একসঙ্গে বসে গিটার আর কাহনের তালে তালে গানের আড্ডাটা ভালোই জমতো।

প্রতিদিনের টুকরো টুকরো রিহার্সেলের এর মাধ্যমেই চলেছে আমাদের অনুষ্ঠানে প্রস্তুতি। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা অন্যতম নির্মম সত্য হলো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সবাই হতাশ। কেউ সিজিপিএ নিয়ে, কেউ ক্যারিয়ার নিয়ে, কেউ পারিবারিক কলহ বা প্রেমিকার ছলনা নিয়ে। সবাই হতাশায় নিমজ্জিত। এই ‘কৃষ্ণচূড়া’র প্রস্তুতি উপলক্ষে সবাই কীভাবে কীভাবে যেন কৃত্রিমতা আর হতাশা ভুলে বসন্ত বরণে সবাই একে অপরের জন্য মন প্রাণ উজাড় করে দেয়। সবাই মিলে  প্রাণবন্ত এক অনুষ্ঠানের জন্য কী এক আপ্রাণ চেষ্টা। বিষয়টা দেখে খুবই বিস্মিত হই। যাই হোক অনুষ্ঠানের আগের রাতে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছেলে–মেয়েদের ব্রেড বোর্ড আর অ্যারোডায়নামিকের স্ট্রাকচার রেখে, রঙিন কাগজ আর কাঁচি নিয়ে ক্যাম্পাস সাজানোর উপকরণ তৈরির পারদর্শীতায়  মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে না। বিশেষ করে আপুদের কথা না বললেই নয়। সারা দিন অনুশীলন ও ক্যাম্পাস সাজানোর কাজ চলে। দিন পেরিয়ে রাত হয় কিন্তু একফোঁটা হতাশা নেই মানুষগুলোর চোখে মুখে। কাজ শেষ করে হলে ফিরতে ফিরতে রাত ১টা ৩০ বাজলেও পরের দিনের জন্য ল্যাব রিপোর্ট কিন্তু ঠিকই লিখতে হয়েছে।
যথাযথ সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হলো।

সব হতাশা, কষ্ট, যন্ত্রণা ভুলে সবাই মেতে উঠলো বসন্ত বরণে, ফাগুনের কোমল হাওয়া গায়ে মেখে একটু শান্তির নিশ্বাস ফেলার সময় হলো সবার। সবাই মন প্রাণ খুলে উদ্‌যাপন করল এ প্রাণের উৎসব। এই একটুকরো উৎসব আমাদের রুক্ষ–নির্জীব মনে একটু হলেও প্রাণসঞ্চার করেছে। নতুন করে মনটাকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় কানে কানে বলে ‘কৃষ্ণচূড়া’ বিদায় নিল এক বছরের জন্য। এখন আবার ফিরে যেতে হবে চিরচেনা সেই নিয়মের গণ্ডিতে। ধন্যবাদ আয়োজকদের আমাদের এমন একটা প্রাণসঞ্চারী উৎসব উপহার দেওয়ার জন্য।

*লেখক: জায়েদ খান, প্রথম বর্ষের ছাত্র, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়।