আমার এক ছাত্রের গল্প
আমার জীবনে আমি বেশ কয়েকটি টিউশনি করেছি। আমার ছাত্রছাত্রীদের একজনের কাহিনিই আজ লিখতে চলেছি।
শ্যাম, ইন্দ্র ও কৃষ্ণ—তিন ভাই। শ্যাম ( অষ্টম শ্রেণি), ইন্দ্র (দ্বিতীয় শ্রেণি)। এই দুই ভাই আমার কাছে পড়ত। আর কৃষ্ণের বয়স ছিল মাত্র এক বছর পাঁচ মাস। তাদের বাবা একটি সরকারি স্কুলের পরিচ্ছন্নতাকর্মী ছিলেন। তাঁরা দলিত শ্রেণির। আমি যখন পড়াতে যেতাম, তার কিছুদিন আগে তাঁরা নিরামিষাশী হয়েছিলেন। তাঁদের মাতৃভাষা হিন্দি। নিজেরা সব সময় হিন্দি ভাষায় কথা বলতেন। বাংলা বলতে পারলেও লেখা, পড়া এবং সাধারণ বা কঠিন বাংলা প্রায়ই বুঝতে পারতেন না।
আমার আজকের গল্প কিশোর শ্যামকে নিয়ে।
শ্যামের বাবা ঝন্টুলাল চাকরির পাশাপাশি বাকি সময়টা স্কুলের শিক্ষকদের বাসায় গিয়ে পরিচ্ছন্নতার কাজ করে বেশ উপার্জন করতেন। নিজেকে কোনো বিশ্রাম না দিয়ে নিরলস পরিশ্রম করতেন। কারণ, তিনি পরিবারকে একটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুন্দর ও খোলামেলা ফ্ল্যাটে রাখতেন। সব উৎসবে ভালো জামাকাপড় কিনে দিতেন। বেড়াতে নিয়ে যেতেন। ভালো শিক্ষক দিয়ে পড়াতেন এবং সন্তানদের সুন্দর একটি জীবন নিশ্চিত করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু শ্যাম তার বাবার এই পরিশ্রমকে বুঝতে পারত না। সমাজের মানুষের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান ভেদে যে ঘৃণ্যতম পার্থক্য বিরাজমান, সেটা উপলব্ধি করার মতো মানসিক গঠন তখনো তার হয়ে ওঠেনি।
শ্যাম যে স্কুলে পড়ত, তার বাবা সেখানেই চাকরি করতেন। সব শিক্ষকের অলিখিত অধিকার ছিল, যা মুখে আসে, সেভাবেই তাঁদের সব বিষয়ে কথা বলার। শ্যাম যেহেতু ভালো ও পরিষ্কার কাপড় পরত, প্রমিত বাংলায় কথা বলত (কারণ সে হিন্দি থেকে বাংলা অনুবাদ করে বলত), স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোয় খুব ভালো করত, তাই তাকে নিয়ে শিক্ষকেরা তার বাবার সামনে বা পেছনে সব সময় মজা করতেন, তিরস্কার করতেন। কখনো বলতেন, ‘কি হে ঝন্টুলাল, তোমার ছেলের ভালো সাহস, খুব নেতাগিরি করে। বোঝায়-ই যায় না, তোমার ছেলে। ভাবসাব দেখে তো অফিসারের ছেলে লাগে।’
শ্যাম পড়াশোনাকে ভয় পেত, বিশেষ করে অঙ্ক। তাই তার বাবা বিদ্যালয়েরই একজন অঙ্ক স্যারের কাছে অনুরোধ করলেন পড়ানোর জন্য। আমি পড়াতাম ইংরেজি। অঙ্ক স্যার বললেন পরে জানাবেন।
শ্যাম যেহেতু গান, আবৃত্তি এবং সুন্দর করে কথা বলত, তাই মেয়েরা তাকে বেশ পছন্দ করত। এটা নিয়ে তার সহপাঠীরা বেশ ঠাট্টা করত।
একদিন শ্যাম দেখল ক্লাসে বসে কিছু ছেলে ভেপ (ইলেকট্রনিক সিগারেট) টানছে। এর ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট হয় বলে শ্যাম তাদের বাইরে যেতে বলে। তারা তখন বলল, ‘যাব না। কী করবি!’ এক কথায় দুই কথায় তারা বলে, ‘তুই সুইপারের ছেলে, তোর এত সাহস হয় কীভাবে আমাদের সমানে কথা বলার! ক্লাসে বসেই টানব ভেপ, কী করবি কর, সুইপারের বাচ্চা!’ শ্যাম তখন অধ্যক্ষের কাছে গিয়ে অভিযোগ করে, ক্লাসে ছেলেরা সিগারেট খাচ্ছে। অধ্যক্ষ এসে ছেলেগুলোকে অনেক বকাঝকা করেন এবং তাদের অভিভাবকদের ডেকে পাঠান। অভিভাবকেরা বলেন, ‘আমাদের বাচ্চারা সিগারেট খাচ্ছিল, কিন্তু ক্লাসে শিক্ষক কেন ছিলেন না?’ সব দোষ শিক্ষকের। তিনি ক্লাসে তখন উপস্থিত থাকলে এ ঘটনা ঘটত না। তাঁরা তাঁদের সন্তানদেরও কোনো শাষণ করেন না। অধ্যক্ষ তখন শ্রেণিশিক্ষককে ডেকে যা খুশি বলেন। সেই শিক্ষক আবার শ্যামের বাবাকে ডেকে অনেক অপমান করেন।
এদিকে অঙ্কের স্যার একদিন শ্যামকে পড়তে তাঁর বাসায় ডেকে পাঠালেন। শ্যাম পড়তে গিয়ে দেখে, সেই সিগারেট খাওয়া ছেলেগুলোও ওখানে পড়ে। শ্যাম ছিল মানুষ হিসেবে বেশ ভীতু। ওরাও শ্যামকে বলল, ‘তোকে তো এখানে যেকোনো কিছুতে ফাঁসিয়ে পড়তে দেব না।’ শ্যাম বলল, ‘দেখো, স্কুলে যা হয়েছে বাদ দিয়ে আমরা পড়াশোনা করি।’ কিন্তু ছেলেগুলো তাকে নানাভাবে জ্বালাতন করত।
শ্যাম একদিন কান্না করে ফেলল, ‘দেখো, আমাকে তোমরা ক্ষমা করো, আমাকে এমন মানসিক অত্যাচার কোরো না।’ ছেলেগুলো তখন বলে, ‘একটা কাজ করলে তোকে সহজেই ছেড়ে দেব। যদি তুই স্যারের কাছে থাকা এসএসসির রিটেন খাতায় দাগ দিয়ে দিস।’ শ্যাম পরদিন তাই করে। এদিকে স্যার খাতা দেখতে গিয়ে তো রেগে আগুন, কে করল এ রকম ঘৃণ্য কাজ। ছেলেগুলোও তখন শ্যামের নাম বলে। স্যার তখন শ্যামকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেন এবং হুমকি দেন স্কুল থেকেও বের করে দেবেন। এমনকি ওর বাবার চাকরিও খেয়ে দেবেন। শ্যামের বাবা তখন একটি বিশেষ প্রয়োজনে কলকাতা গিয়েছিলেন। আমি শ্যামের মায়ের কাছে ঘটনার বিবরণ শুনে পরিচিত স্যারদের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, খাতায় এমন জায়গায় দাগ দেওয়ায় কোনো সমস্যা হবে কি না। তাঁরা জানালেন কোনো সমস্যা হবে না।
শ্যামের মা অঙ্ক স্যারের কাছে নিজেই গেলেন ক্ষমা চাইতে। স্যার শ্যামের মাকে বললেন, ‘এ কাজের জন্য তাঁর চাকরিই চলে যাবে হয়তো। আর আমার চাকরি গেলে, ঝন্টুলালের চাকরিও খাব আমি।’ শ্যামের মা স্যারের পা জড়িয়ে ধরেন, কিন্তু তিনি খুব খারাপ আচরণ করে শ্যামের মাকে বাসা থেকে বের করে দেন।
শ্যামের মা কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে বলেন, তার বাবা তাকে মেরে ফেলবে। শ্যাম একপর্যায়ে এসব চাপ ও দুঃখে মনে মনে হয়তো সিদ্ধান্ত নেয়, তার বাবার চাকরি যাওয়ার আগেই সে আত্মহত্যা করবে। আমি সেদিনকার মতো বাসায় চলে আসি।
পরদিন সকালে শুনতে পাই, শ্যাম আত্মহত্যা করার জন্য তার ঠাকুরমার রেখে যাওয়া ৫০টা ঘুমের বড়ি খেয়ে নিয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি।
পরে আমি আরও কিছু বিশেষজ্ঞের কাছে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হই যে ওই খাতার জন্য কোনো সমস্যাই হতো না। একজন নির্দয় শিক্ষকের করা নিষ্ঠুর আচরণ এবং দুষ্ট বন্ধুদের করা ষড়যন্ত্রে হয়তো সেদিন শ্যামের জীবনটা শেষ হয়ে যেতে পারত। ঘটনাটি আমাকে মানসিকভাবেও খুব ভাবিয়েছিল।
*লেখক: লিয়া খাতুন, রোকেয়া হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]