নারী কেন জমিবিরোধের সহিংসতার বলি হবে

নারীর প্রতীকী ছবি

ক্ষণার বচনে ‘ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন’। ভাইয়ের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী পিতার মৃত্যুর পর ভাইয়ের কাছে উত্তরাধিকার সম্পত্তির দাবি করেন না। আবার যাঁরা দাবি করেন, তাঁদের অনেকেই নিজের ভাই এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের দ্বারা অপমান, লাঞ্ছনা ও শারীরিক নির্যাতনের শিকারও হন। অর্থের টানের কারণে তুচ্ছ হয়ে যায় রক্তের বাঁধন। হারিয়ে যায় বোনের প্রতি ভাইয়ের চিরায়ত ভালোবাসা। হায় রে ঠুনকো রক্তের বাঁধন।

জমির প্রকৃত মালিকানা না পাওয়ার বঞ্চনার পাশাপাশি নারী জমিসংক্রান্ত যেকোনো সহিংসতার শিকারও হচ্ছেন সবার আগে। জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রাণহানি, বাড়িঘরে আগুন দেওয়া, হামলা, গুম, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, আহত মানুষের সংখ্যা এবং মামলার সংখ্যা আমাদের দেশে আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অহরহ সংঘটিত ভূমিসংক্রান্ত জটিলতা নারীর নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলছে। ভূমিবিরোধের জেরে নারীরা শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক—সব ধরনের নিপীড়ন ও সহিংস নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বেশি।

দেশে জমিসংক্রান্ত সহিংসতা ও মানুষের নিরাপত্তার ওপর তার প্রভাবের চিত্র উঠে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের (সিজিএস) করা গবেষণা প্রতিবেদনে। এতে দেখা যায়, দেশে জমি নিয়ে বিরোধে সহিংসতা, প্রাণহানি, আহত মানুষের সংখ্যা ও মামলা বাড়ছে। দেশের প্রায় ৫০ লাখ পরিবার সরাসরি জমিসংক্রান্ত বিরোধের মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া ৬ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার ভবিষ্যতে জমি নিয়ে বিরোধের আশঙ্কায় রয়েছে। আদালতে জমিসংক্রান্ত প্রায় ১৪ লাখ মামলা অমীমাংসিত। মামলা চালাতে গিয়ে পরিবারগুলো সর্বস্বান্ত হয়। মামলাগুলো মীমাংসা হতে কয়েক প্রজন্ম চলে যায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ প্রকাশিত ‘জেন্ডার স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশ ২০১৮’ রিপোর্ট থেকে জানা যায়, শহরের চেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন গ্রামের নারীরা, আর তাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন মানসিক রোগে। নির্যাতিত নারীদের মধ্যে মধ্যবয়সী নারীই বেশি। জীবনে অন্তত একবার মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, দেশে এমন নারী ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি গ্রামে—২৯ দশমিক ৭ শতাংশ। শহরে এ হার ২৫ দশমিক ৪।

সিনেমা, নাটক বা হালের ওয়েব সিরিজগুলো আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া বাস্তবতার ঘটনাগুলোকেই তুলে ধরে। গ্রাম কিংবা শহরে—সব জায়গাতেই দেখা যায় জমির জন্য পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী কিংবা স্থানীয় লোকজনের প্রথম লক্ষ্যবস্তু হন নারীরা। প্রতিপক্ষ পরিবারে জমির বিরোধ থেকে নারীদের ওপর হামলা, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটে। ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে জমি জবরদখলের অন্যতম কৌশল হিসেবে সেই পরিবারের নারীকে প্রথম লক্ষ্যবস্তু করা হয়। এ ছাড়া বয়স্ক ও বিধবা নারীরা সম্পত্তির জন্য ছেলে ও পরিবারের অন্য সদস্যদের দ্বারাও নির্যাতনের শিকার হন।

বাংলাদেশে অধিকাংশ নারীই ভূমিহীন। ধর্মভেদে নারীরা সম্পত্তি কেনাবেচার সম্পূর্ণ অধিকার পান না, পেলেও সীমিত আকারে পান। উত্তরাধিকার সূত্রে বা খাসজমিতে নারীর যতটুকু অধিকার পাওয়ার কথা, ততটুকু অধিকার সে আদতে পান না। অনেক ক্ষেত্রে অধিকারহীনতার মাত্রা চরম। নারীরা গ্রামীণ কৃষিজমির মাত্র ২ থেকে ৪ শতাংশের মালিক। সম্পত্তির নথিপত্রে নাম আছে ১০ শতাংশের কম নারীর।

এ বঞ্চনার সঙ্গে আরও যুক্ত হয়েছে ভূমি অধিগ্রহণ-হুকুমদখলসহ নানা সরকারি-বেসরকারি জবরদখল প্রক্রিয়া, যা নারীর ভূমি অধিকারকে চরমভাবে লঙ্ঘন করে। কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি যে গ্রামাঞ্চলে প্রায় প্রতিটি পরিবারে পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ রয়েছে। এ বিষয়ে গ্রামীণ নারীদের সঙ্গে কথা বলে আমরা জানতে পেরেছি, জমিসংক্রান্ত পারিবারিক অশান্তিতে রয়েছে পরিবারের নারীরা।

বাপের বাড়ির সম্পত্তি না আনার জন্য তাঁরা স্বামী দ্বারা মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অন্যদিকে ভাইয়ের কাছে সম্পত্তি চাইতে গিয়ে অসম্মান ও অপমানের শিকার হচ্ছেন।

ভূমি অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সহিংসতার এমন অনেক ঘটনা আমাদের কাছে আসে। ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর রাতে সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন বকুল বেগমকে। সে সময়ে তাঁর বড় বোন মুকুল বেগমকেও কুপিয়ে আহত করা হয়। সহিংস এ ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলাধীন চর মুজিবনগরে (চর শিকদার)। চরের জমিতে ভূমিহীন মানুষদের বন্দোবস্ত প্রদান বাধাগ্রস্ত করতে অবৈধ দখলদার ভূমিগ্রাসীরা এ দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্মে জমিসংক্রান্ত হামলা-মামলার ঘটনায় পুরুষেরা বাড়িছাড়া হন। আদিবাসী সাঁওতাল নারীরা দিন-রাত পাহারা দিয়ে তাঁদের জমি আগলে রাখেন। এতেও নারীরা নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হন।

এ মাসেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে এক নারীকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে এবং তাঁর মাথার চুল কেটে দেওয়া হয়েছে (৪ নভেম্বর, যুগান্তর)।

আবার জমিসংক্রান্ত মামলায় পরিবারের কর্মক্ষম পুরুষটি গ্রেপ্তার হওয়ায় অসহায়ত্বের মধ্যে পড়তে হয় বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও কন্যাসন্তানকে। তাঁদের জীবন-জীবিকা, সন্তানের লেখাপড়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এমনও ঘটনা আছে, যাঁরা দীর্ঘদিন যাবৎ পূর্বপুরুষের জমি নিয়ে বিরোধের জেরে পলাতক। পরিবারের খরচ চালাতে স্ত্রী মানুষের বাসায় কাজ করছেন। সন্তানদের পড়াশোনাও বন্ধ। জীবনের এই সংগ্রাম চালাতে গিয়ে নারীর সামাজিক, মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে বাংলাদেশে জমিজমা নিয়ে বিরোধ ও সহিংসতা অনেক বেশি। আর সেটা দিন দিন বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে নারীর প্রতি নির্যাতনের মাত্রাও। নিত্যদিনের এই ব্যাধি থেকে নারী পরিবারে, সমাজে কোথাও রেহাই পাচ্ছেন না।

অমীমাংসিত ভূমিবিরোধের কারণে সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরাধীরা অস্ত্র হিসেবে নারীর ওপর সবার আগে আঘাত হানে আক্রান্ত পরিবারটিকে আরও দুর্বল করে দেওয়ার জন্য। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, চিকিৎসা ও আইনি বিচারে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীরা এবং চরাঞ্চলের নারীরা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন।

বাংলাদেশে নারীর প্রতি ভূমিসংক্রান্ত সহিংসতা এখন উদ্বেগের বিষয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

  • লেখক: সানজিদা খান: প্রোগ্রাম ম্যানেজার, এএলআরডি