বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের কথা কতটা ভাবে প্রশাসন
বিশ্ববিদ্যালয়পাড়ায় কোনো ছাত্র আন্দোলন সংঘটিত হলে প্রায়ই প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা দেখা যায়। এটাই যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি। শুরুর দিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে শিক্ষকদের আলাপ-আলোচনার কোনো কথা শোনা যায় না। আন্দোলন ইস্যুতে কোনো ‘হ্যাঁ-না’ মতামতও থাকে না। প্রয়াত শামসুজ্জোহা স্যারের মতো যৌক্তিক আন্দোলনে শিক্ষকদের সমর্থন তো উধাও হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষকের ভূমিকা দেখা গেলেও বাকিরা ক্ষমতা আর পদোন্নতির লোভে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন।
তবে ছাত্র আন্দোলন কিছুটা প্রকট হয়ে উঠলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর বা শিক্ষক সমিতি থেকে পরিস্থিতি বুঝে একটা দায়সারা বিবৃতি দেওয়া হয়। তাতেও কিছু না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায় চলে পুলিশি মহড়া। আন্দোলনের মাত্রা বেড়ে গেলে প্রশাসনের নজর পড়ে আবাসিক হলগুলোয়। যত দ্রুত সম্ভব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের একটা নোটিশ ঝুলিয়ে শিক্ষার্থীদের হলছাড়া করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হয়তো ধারণা, আবাসিক হল বন্ধ করলেই আন্দোলনের সহিংসতা কমে আসবে। শিক্ষার্থীরা যৌক্তিক আন্দোলন থেকে সরে আসবেন। এই আদি ধারণা বিএনপির সর্বশেষ আমল থেকে এখন পর্যন্ত দেখে আসছি। তার আগে থেকেও এই রীতি শুরু হতে পারে। প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয় বা আবাসিক হল বন্ধের সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের কথা কতটা ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন?
দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল আছে। এসব হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী অবস্থান করেন। এসব শিক্ষার্থীর বাড়ি আবার ভিন্ন ভিন্ন জেলায়। কারও বাড়ি রংপুর তো কারও বাড়ি সাতক্ষীরায়। আবার কেউ এসেছেন কক্সবাজার উপকূল থেকে, কেউ–বা মেহেরপুরের শেষ প্রান্ত থেকে। উচ্চশিক্ষা লাভের আশায় প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন দূরদূরান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীদের অবস্থান রয়েছে। শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া মেটাতে না পেরে যখন হুট করে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন কি প্রশাসন একবারও ভাবে, এসব শিক্ষার্থী কোথায় যাবেন? কার কাছে থাকবেন? কী খাবেন? ধরুন, একজন শিক্ষার্থী রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, যাঁর গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর কুয়াকাটায়। এই শিক্ষার্থীর এত পথ পাড়ি দিতে কত সময় লাগবে, তা নিয়ে প্রশাসনের মাথাব্যথা আছে কি? এরপর আছে আর্থিক দৈন্যের বিষয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী নিম্নমধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত ঘরের সন্তান। লম্বা দূরত্ব থেকে আসা এসব শিক্ষার্থীর অনেকেই ভাড়ার টাকার অভাবে বছরে এক–দুবার বাড়ি যান। কেউ–বা দুই বছরে একবার যান। অনেকে আছেন চাকরি না পাওয়ার হতাশায় বছরের পর বছর বাড়ি যান না। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের আচমকা সিদ্ধান্তে এসব শিক্ষার্থী টাকা জোগাড় নিয়ে যে হিমশিম খান, যে অস্বস্তিতে ভৌগেন, তা কি কখনো অনুধাবন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন?
সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেশজুড়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেয় সরকার। দেখাদেখি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও একই পদাঙ্ক অনুসরণ করে। নামে স্বায়ত্তশাসিত হলেও কাজের বেলায় সরকারের সিদ্ধান্তে ‘ইয়েস’ বলতে মোটেও দেরি করেনি দেশের সব স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুপুরে নেওয়া সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্তে সন্ধ্যার মধ্যে হল ছাড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। এতে কে কোথায় যাবেন, কার বাসায় উঠবেন, তা নিয়ে অনেককেই দুশ্চিন্তা করতে দেখা যায়। নারী শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কথা নাই–বা বললাম। অনেক শিক্ষার্থী আছেন, যাঁদের ঢাকায় আত্মীয় বলতে কেউ নেই। তাঁদের হতাশাগ্রস্ত মলিন মুখ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেখা প্রয়োজন। কাছাকাছি জেলার শিক্ষার্থীরা রাতের মধ্যে চলে যেতে পারলেও দূরদূরান্তের শিক্ষার্থীরা আশ্রয় নেন আত্মীয়স্বজনের বাসায় বা বন্ধুদের মেসে। সম্প্রতি প্রথম আলোর করা এক প্রতিবেদনে দেখলাম, বরিশাল, শাহজালাল ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের মেসগুলোতে একজনের সিটে তিন–চারজন করে আশ্রয় নিয়েছেন। কারফিউ ও অচল ইন্টারনেট–ব্যবস্থায় তাঁদের আর্থিক দৈন্য সীমা ছাড়িয়েছে। থাকার জায়গা নেই, খাবারের ব্যবস্থা নেই, পয়োনিষ্কাশনের যা–তা অবস্থা। এসব কিছুর কারণ, গভীর চিন্তাহীন বিশ্ববিদ্যালয়ের হুট করে নেওয়া আদি সিদ্ধান্ত।
দেশজুড়ে উত্তাল পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়েও হয়তো ভাবেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নাহয় রণক্ষেত্রের মাঝে হঠাৎ সন্তানের হাত ছেড়ে দেওয়া কীভাবে একজন পিতার কর্ম হতে পারে! চলমান আন্দোলনে যতজন মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁদের অনেকেই পথচারী বা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। হল ছেড়ে বাড়িতে পৌঁছাতে গিয়ে পথিমধ্যে কোনো শিক্ষার্থী যদি হামলার শিকার হতেন, এর দায় কি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন নিত? আবাসিক হল ছেড়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষার্থী আশপাশে বন্ধুদের মেসে আশ্রয় নিয়েছেন। দেশের সর্বস্তরে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় দূর থেকে আসা এসব শিক্ষার্থী বাড়ি যেতে চেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতা। কিন্তু প্রশাসন তাঁদের নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বাস দিতে পারবে না বলে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মেসে আশ্রয় নিয়েও আতঙ্কে দিন কাটিয়েছেন।
সেখানে পুলিশি তল্লাশি চালানো হয়েছে। এমনকি একজন শিক্ষার্থী তল্লাশির ভয়ে পালাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে দৈনিক প্রথম আলো। এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মেসেও তল্লাশি চালানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্তে একজন দূরপথের শিক্ষার্থী বা নিম্নবিত্ত ছাত্র যে বন্ধুদের মেসে আশ্রয় নেবেন, এর সুযোগও নেই। সেখানেও কোনো শিক্ষার্থী নিরাপদ নন। তাহলে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বুলি শোনানো ব্যক্তিরা এমন সিদ্ধান্ত কীভাবে নিয়ে থাকেন? নাকি সেসব ফাঁকা বুলি?
শিক্ষার্থীরা দেশের সম্পদ, জাতির ভবিষ্যৎ। এ শিক্ষার্থীরাই তো একদিন দেশের বিভিন্ন পদে বসে নেতৃত্ব দেবেন, বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের নাম তুলে ধরবেন। শিক্ষার্থীদের গবেষণা, চিন্তাধারা থেকে ভবিষ্যতে স্মার্ট বাংলাদেশের সোপান পেরিয়ে আরও উন্নতির শিখর ছুঁবে লাল-সবুজের দেশ। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সামনে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আরও বৃদ্ধি পাবে, অর্থনীতিতে একদিন এশিয়ার শীর্ষ তালিকায় জায়গা করে নেবে। শিক্ষার্থীদের অবদানে প্রযুক্তিতে বড় স্বপ্ন দেখতে পারে বাংলাদেশ। তাঁরাই তো হবেন আগামী দিনের কাণ্ডারি, নেতৃত্ব দানকারী। তবু এসব শিক্ষার্থীকে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না দেওয়া হয়, সংঘাত-সহিংসতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়, তাতে কোনোমতে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক শেষ করে দেশান্তরী হওয়ার যে হিড়িক চলছে দেশে, তা ঠেকানো যাবে না।
এতে বড় ক্ষতির মুখে পড়বে দেশ। উচ্ছন্নে যাবে শিক্ষার্থীদের পেছনে ব্যয় করা সরকারের এত দিনের বিনিয়োগ। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য নেওয়া যেকোনো সিদ্ধান্তে আরেকটু সদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে আশা করা নিশ্চয়ই দোষের কিছু নয়।
লেখক: ফারহান আরেফিন, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়