সুন্দরবন থেকে সাফ ফুটবলে

সহ ফুটবলারদের সঙ্গে সাথি মুন্ডাছবি: লেখকের সৌজন্যে

না, আমি তাঁকে এখনো দেখিনি। অনূর্ধ্ব-১৬ বাংলাদেশ জাতীয় প্রমীলা ফুটবল দলের পক্ষে গত ১০ মার্চ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে ভারতের বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচে পঞ্চম পেনাল্টি থেকে বাংলাদেশকে ৩-২ গোলে এগিয়ে দেওয়া ডিফেন্ডার সাথি মুন্ডাকে আমি এখনো দেখিনি। তবে কাকতালীয়ভাবে হলেও সাথি মুন্ডার মায়ের সঙ্গে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে আমার পরিচয় হয় যখন সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় সুন্দরবনের নিকটবর্তী একটি মুন্ডা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর গ্রাম দাতিনাখালি মুন্ডা পাড়ায় আমি শ্যামনগর অঞ্চলের ‘লৈঙ্গিক সমতাবিষয়ক অবস্থান’ বোঝার উদ্দেশ্যে একটি ’ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন (এফজিডি)’ পরিচালনা করছিলাম।

অন্ত্য-ফেব্রুয়ারির এক উত্তপ্ত দুপুরে আমার বর্তমান কর্মক্ষেত্র বিফরআরএল-সিএনআরএসের কিছু মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাসহ আমি পৌঁছে গিয়েছিলাম দাতিনাখালি মুন্ডা পাড়ায়। গ্রামটি চুনা নামে এক শান্ত নদীর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আর নদীর অপর পারে রয়েছে রাজসিক সুন্দরবন তথা পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল।
ছোট্ট এই গ্রামটিতে তার ছোট ছোট মাটির দেয়ালের কুঁড়েঘর কিন্তু নিকোনো, ঝকঝকে উঠোনের ছবির মতো চেহারায় আমাকে অভ্যর্থনা জানাল। নারীরা সেই মাটির উঠোনে মাদুর পেতে বসে ছিলেন এবং দেখলাম যে তাঁদের উঠোনের ঢাল বেয়ে একটু নিচে নামলেই চুনা নদীর তীর, যেখানে কিছু শুভ্র রাজহাঁস চরে বেড়াচ্ছে।

যা হোক, দ্রুতই আমাদের ‘এফজিডি’ আলোচনা শুরু হলো এবং শুরুতে জেন্ডার বা লৈঙ্গিক অবস্থানবিষয়ক যেকোনো আলোচনায় যেসব বিষয়ে আলাপ হয়, যেমন কৃষি খাতে দিনমজুর হিসেবে নর-নারীর বেতনবৈষম্য, পরিবারে নর-নারীর পুষ্টিগত অসমতা, মেয়েদের গড় বিয়ের এবং শিক্ষার বয়স বিষয়ে আমাদের প্রশ্নমালার পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যাশিত সব উত্তরই আসতে থাকে। যেমন মেয়েরা দিনমজুর হিসেবে পুরুষদের তুলনায় কম মজুরি পান, নারীরা আজও সংসারে কম পুষ্টিকর খাবার খান এবং প্রায়ই ১৪-১৭ বছরের মেয়েদের বয়স বার্থ সার্টিফিকেটে ১৮+ বা ২০+ দেখিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যেই না আমি প্রশ্ন করলাম যে মেয়েরা এ সমাজে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলার অনুমতি পায় কি না, তখনই আলোচনায় উপস্থিত মুন্ডা নারীরা একজন ২৭-৩০ বছর বয়সী শীর্ণ নারীর দিকে আঙুল তুলে দেখাল।

‘ও হচ্ছে প্রতিমা মুন্ডা। সাথি মুন্ডার মা—আমাদের গ্রামের মেয়ে সাথি মুন্ডা নেপালে খেলতে গেছে। অনূর্ধ্ব-১৬ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলে ও চান্স পেয়েছে’—উপস্থিত অন্য নারীরা আমাকে জানালেন।
অবাক হয়ে প্রতিমার মাকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম যে তাঁর মেয়ের ফুটবলার হওয়ার যাত্রাটা যদি তিনি একটু ব্যাখ্যা করেন। তখন নিতান্ত সহজ-সরল নারীটি আমাকে বললেন, ‘আমার বিয়ে হয়েছিল ১৪ বছর বয়সে আর আজ আমার মেয়েরই বয়স ১৩। প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ও ফুটবল খেলতে ভালোবাসত। কিন্তু ওর বাবা শুরুতে মানতে চাইত না। তখন ওদের স্কুলের মাসুম স্যার এসে আমাদের অনেক বোঝান। আমাদের সমাজ, পাড়া-প্রতিবেশী বা রাস্তাঘাটে কোনো মেয়ে ছেলেদের মতো পোশাক পরে খেলতে গেলে কেমন বাঁকা কথা শুনতে হয়, আপনি তো বোঝেন!’ প্রতিমা মুন্ডা বলেন।

‘কিন্তু আমার মেয়ের খেলার জন্য অসম্ভব টান ছিল। ওর বাবা, পাড়াপড়শি,আত্মীয়স্বজন, রাস্তাঘাটের মানুষ বা এমনকি আমিও ওকে অনেক বকাবকি করেছি। কিন্তু ও তবু খেলা চালিয়েই যাচ্ছিল আর একটা সময় আমি ওকে সমর্থন করতে থাকি। বাকিটা আপনাদের আশীর্বাদ—এখন সবাই ওকে কত প্রশংসা করে!’ সাথির মা প্রতিমা মুন্ডা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন।
সাতক্ষীরা বা খুলনা অঞ্চলের স্থানীয় সংবাদপত্রের মতে, সাথি মুন্ডা তাঁর বাবা দিনমজুর প্রদীপ মুন্ডা ও মা প্রতিমা মুন্ডার মেয়ে। সাথির মা দরজির কাজও করেন। বর্তমানে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সাথি ফুটবলে প্রশিক্ষণ নিতে দুবছর আগেই বিকেএসপিতে যাওয়ার জন্য এলাকা ছেড়ে যায়।
‘এই এলাকায় আজ থেকে ২০০ বছর আগে সাতক্ষীরা অঞ্চলের জমিদার মহসীন সাহেব বিহারের ছোট নাগপুর ও রাঁচি থেকে আমাদের পাঁচ ঘর পূর্বপুরুষ এখানে এনেছিল, যাতে বাদা বন কিছুটা সাফ করে বসবাস ও চাষযোগ্য করে তোলা যায়। যদিও আমাদের সেই পাঁচ ঘর পূর্বপুরুষের প্রত্যেক ঘরকে মাথাপিছু পাঁচ বিঘা জমি দেওয়ার কথা ছিল, তবে সেই প্রতিশ্রুতি আজও পূরণ হয়নি। আজ আমরা এই মুন্ডা পাড়ায় মোট ২৮ পরিবার আছি এবং আমাদের সংখ্যা মোট ১৪০,’ বললেন রহোমণি মুন্ডা নামের আর এক মুন্ডা নারী, যাঁর মেয়ে অঞ্জনা মুন্ডাও একজন অনূর্ধ্ব-১৬ কিশোরী ফুটবল খেলোয়াড় এবং মূলত আঞ্চলিক স্তরে খেলা এই কিশোরী বর্তমানে সাতক্ষীরায় অবস্থান করছেন।

‘আমাদের মতো প্রাচ্যদেশীয় সমাজে মেয়েরা একটু বড় হতে না হতেই বা সোজা কথায় তাদের শৈশব বা কৈশোরে পরিবার, সম্প্রদায় বা সমাজ তাদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণকে সমর্থন করে না বা নিষেধ করে, খেলতে দেয় না; যদিও খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে পারাটাও লৈঙ্গিক সমতা অর্জনের অন্যতম শর্ত।
‘এ দেশে সুদীর্ঘ ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করা পরিবেশবাদী সংগঠন সিএনআরএসের নতুন প্রকল্প বিফরআরএল তার বর্তমানে চলমান লৈঙ্গিক অবস্থানগত পরিপ্রেক্ষিত মূল্যায়ন পর্যালোচনায় সমাজের জেন্ডারবিষয়ক যাবতীয় ইস্যু নিয়েই আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে,’ বলেন সুইডিশ দূতাবাস কর্তৃক অর্থায়িত এই প্রকল্পটির পরিচালক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান।
‘যদিও সিডও সনদের ১০-ছ অনুচ্ছেদে বালিকাদের জন্যও বালকদের সমান খেলাধুলা ও দৈহিক শিক্ষাজনিত নানা অনুশীলনে যোগ দেওয়ার অধিকারকে স্বীকার করেছে, আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা প্রথা প্রায়ই মেয়েদের এসব অধিকার বাস্তবায়িত হতে দেয় না,’ বলেন সিএনআরএসের পরিচালক আনিসুল ইসলাম।

‘আমাদের প্রকল্পের পরবর্তী স্তরে আমরা একটি “বালিকা ও যুব ক্রীড়া ও সংস্কৃতিবিষয়ক ক্লাব’ (গার্ল অ্যান্ড ইওথস স্পোর্টস অ্যান্ড কালচারাল ক্লাব) গঠনের পরিকল্পনা করছি, যা স্থানীয় অভিভাবকদের সামাজিক নানা বিধিনিষেধের দেয়াল ভেঙে তাদের মেয়েদের খেলাধুলায় অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করবে। এটা আমরা আমাদের “জেন্ডার এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরণ” দৃষ্টিভঙ্গি এবং “কাউকেই পিছিয়ে রেখে নয়” নীতির আলোকে করব,’ বলেন সিএনআরএসের পরিচালক ড. মোখলেছুর রহমান।
‘সাতক্ষীরা, খুলনা (দাকোপ ও কয়রা) এবং মাগুরা ও নড়াইল এলাকার তিনটি “পরিবেশগতভাবে সমস্যা সংকুল এলাকা”য় আমাদের এই প্রকল্প বর্তমানে ৩০ হাজার দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষকে ক্ষমতায়িত করছে এবং ক্রীড়া বা খেলাধুলা বালিকা ও তরুণ-তরুণীদের সম্পৃক্তকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে,’ মোখলেছুর রহমান তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেন।

অদিতি ফাল্গুনী: যোগাযোগ ব্যবস্থাপক, বিফরআরএল সিএনআরএস