রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে কাঠামোগত সংস্কারে কয়েকটি প্রস্তাব

ডলার
ছবি: রয়টার্স

প্রথমেই আমার নিজের একটি ঘটনা থেকে শুরু করতে চাই। আমাদের লেখা দুটি বই আমেরিকার আইজিআই গ্লোবাল থেকে প্রকাশ করে এবং প্রাথমিকভাবে আমাদের জন্য রয়্যালটি মঞ্জুর করে। রয়্যালটি যখন ব্যাংকিং চ্যানেলে বাংলাদেশে নিয়ে এলাম, তখন ব্যাংক ১০ শতাংশ ট্যাক্স ধার্য করে। পরে আমি একজন সিনিয়র আয়কর কর্মকর্তার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি জানালেন, ‘তুমি যেহেতু দেশে থেকে ডলার আয় করেছ, তাই তোমায় ট্যাক্স দিতে হবে!’ আমি অবাক হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, প্রবাসী শ্রমিকদের আয় নিয়ে আসার জন্য যেখানে প্রণোদনা দেওয়া হয়, সেখানে আমাদের ডলারে আয় থেকে ট্যাক্স কেটে রাখা হয়! এর মানে, হাজার হাজার বাংলাদেশি, যাঁরা দেশে বসে ডলারে আয় করেন, তাঁদের কোনো প্রণোদনা দেওয়া হয় না এবং ট্যাক্স দিয়ে অর্থ হাতে পেতে হয়। প্রথমেই বলব, এখানে নীতিগত সংস্কার একান্ত প্রয়োজন।  

এখন দেখে নেওয়া যাক বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের কয়েকটি উৎস এবং বৈধভাবে আসার পদ্ধতি। রেমিট্যান্সের অন্যতম উৎস রপ্তানি আয়, এ ক্ষেত্রে বার্তা আসার একমাত্র মাধ্যম সুইফট। সুইফট বার্তা আসে প্রথমত ব্যাংকের হেড অফিসের আন্তর্জাতিক বিভাগে এবং পরবর্তী সময়ে হেড অফিসের কর্মকর্তা নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন ব্রাঞ্চে ফরওয়ার্ড করেন, যা পুরোপুরি অটোমেটিক নয় এবং এ প্রক্রিয়ায় সময় লাগে অন্তত তিন দিন। এ ক্ষেত্রে এআই ব্যবহার করে অটোমেটিকভাবে ব্রাঞ্চে সুইফট বার্তা পাঠানোর ব্যবস্থা করা গেলে রিয়াল টাইম বার্তা প্রেরণ সম্ভব হতো। এটা হতে পারে একটি কাঠামোগত সংস্কার।

রেমিট্যান্সের দ্বিতীয় প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। প্রবাসীরা সাধারণত মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে গোপন পিন নম্বরের ভিত্তিতে বা কোনো ব্যাংক হিসাবে অর্থ পাঠাতে পারেন। এর বাইরে ব্যাংকের মাধ্যমে সুইফট বার্তা দিয়েও রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেন, যদিও এ প্রক্রিয়ায় খুব কমই রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। এ বিষয়ে ইউরোপে থাকেন, এমন কয়েকজন প্রবাসীর সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, যেহেতু তাঁরা রেমিট্যান্সের ওপর প্রণোদনা পান, তাই তাঁরা বেশ খুশি। তবে ইদানীং একটি সমস্যা হয়, তা হলো নির্দিষ্ট অঙ্কের বেশি অর্থ তাঁরা দেশে পাঠাতে পারেন না সংশ্লিষ্ট দেশের আইনের কারণে অথবা পাঠাতে হলে ওই সব দেশে অতিরিক্ত ট্যাক্স দিতে হয়। তাই বিশেষ প্রয়োজন হলে তাঁরা হুন্ডির সহায়তা নেন; অর্থাৎ হুন্ডি এখানে টিকে গেছে। এ প্রক্রিয়ায় কোনো সমাধান এ মুহূর্তে আমার জানা নেই। অন্যদিকে অনেকেই বিদেশে অবৈধভাবে আছেন, তাঁদের জন্যও ভরসা হুন্ডি। এ বিষয় যাঁরা আইনে দক্ষ, তাঁরা কোনো সমাধান নিয়ে আসবেন বলে আসা রাখি।

রেমিট্যান্সের অন্যতম আরেকটি উৎস হলো ফ্রিল্যান্সের মাধ্যমে আয়, যাঁরা সবাই দেশেই থাকেন, তাঁর পরিবার ও সন্তানদের সময় দেন, সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখেন। এখানে উল্লেখ্য, ফ্রিল্যান্স যাঁরা করেন, তাঁরা প্রত্যেকে বিদেশে ট্যাক্স দিয়ে আয় করেন, তাঁদের যেন বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার ট্যাক্স দিতে না হয় এবং প্রবাসীদের মতো প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দেওয়া হয়। একজন ফ্রিল্যান্সার মনের দুঃখে বলেছিলেন, ‘প্রবাসীদের ডলার ডলার, আর আমাদের ডলার কি ডলার নয়; তাহলে প্রণোদনা কেন নয়?’ উল্লেখ্য, রপ্তানির ক্ষেত্রেও অনেক রকম প্রণোদনা ও স্বল্প সুদে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা রয়েছে।

রেমিট্যান্সের আরও অনেক মাধ্যম রয়েছে। যেমন কনসালট্যান্সি, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা বা ক্লাস প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই ট্যাক্স ফ্রি সুবিধা ও প্রয়োজনীয় প্রণোদনা প্রয়োজন।

অন্যদিকে হুন্ডির কিছু কারণ জানা গেলে তার সমাধানও সহজ হবে। যেমন সেদিন একজন আমেরিকা থেকে বলছিলেন, অনেক হুন্ডি ব্যবসায়ী বাংলাদেশে অগ্রিম অর্থ পৌঁছে দেন; অর্থাৎ তাঁর অর্থের প্রয়োজনে তাঁকে ধার দেন। বাংলাদেশে রপ্তানিকারক ছাড়া অন্য কোনো বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী সহজে ও স্বল্প সুদে ব্যাংকঋণ পান না। অথচ আজকাল একটি মোবাইল কোম্পানিও গ্রাহকদের ধার (ঋণ) দেয়। তাই একটি স্কোরিং মডেল করে প্রত্যেক বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারীর জন্য ব্যাংক থেকে অগ্রিম নেওয়ার ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন। এটা হতে পারে আরেকটি কাঠামোগত সংস্কার। প্রয়োজনে স্কোরিং মডেল করে ঋণদানের কাঠামোগত সংস্কারে সহায়তা করতে প্রস্তুত রয়েছি।

অন্য আরেকজন প্রবাসী বলছিলেন, ‘আমরা দেশে অর্থ পাঠাতে পারলেও দেশ থেকে অর্থ আনতে পারি না এবং অর্থ ফেরত আনার প্রধানতম মাধ্যম অবৈধ হুন্ডি, যা একদিকে যেমন অনিরাপদ; অন্যদিকে ব্যয়বহুল, তাই ভয়ে পাঠাই না। অর্থাৎ রেমিট্যান্স বৃদ্ধির জন্য একদিকে দেশের ভেতরে যেমন প্রণোদনা দিতে হবে, অন্যদিকে বিদেশে ফেরত নেওয়ার আইনগত সংস্কার করা প্রয়োজন। এটা অন্যতম একটি কাঠামোগত সংস্কার।

একজন ফ্রিল্যান্সার মনের দুঃখে বলছিলেন, ‘প্রবাসীদের ডলার ডলার, আর আমাদের ডলার কি ডলার নয়; তাহলে প্রণোদনা কেন নয়।’

অস্ট্রেলিয়ায় এক প্রবাসীর সঙ্গে কথা বলছিলাম। তাঁকে দেশে বিনিয়োগের অনুরোধ করলে তিনি বিনিয়োগের পরিবেশের সংস্কারের দাবি তুলে ধরলেন। তাঁর দাবির কয়েকটি, যেমন ট্যাক্সের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা; অর্থাৎ সবাই যেন নির্ধারিত হারে ট্যাক্স দেন, অন্যথায় প্রতিযোগিতায় ভালোরা টিকতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন অফিসের কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের ভালো ব্যবহার এবং ঘুষ ছাড়াই দ্রুত সময়ে সেবা প্রদান ও নিরাপত্তা প্রভৃতি। তাঁর কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম, যা স্বল্প মেয়াদে কষ্টকর হলেও দীর্ঘ মেয়াদে একান্ত প্রয়োজন। বিদেশি বিনিয়োগ এবং প্রবাসীদের বিনিয়োগ বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ নিশ্চিতভাবেই অনেক বাড়াবে।

অন্যদিকে দীর্ঘ মেয়াদে রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য আমাদের যেমন দক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাঠাতে হবে, অন্যদিকে দেশি ব্যবসায়ীদের নির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে বিদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ দিতে হবে। শিক্ষার মান বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্র্যাজুয়েশন করার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা ব্যাপকভাবে হ্রাস করতে হবে। কারণ, এর ফলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার খরচ হয়। আমাদের শিক্ষার মান বৃদ্ধি পেলে আমরাই বরং পার্শ্ববর্তী দেশের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় আয় বাড়াতে পারব। এটাও হবে একটি কাঠামোগত সংস্কার।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে একক ব্যাংক হিসেবে সবচেয়ে মুনাফা অর্জনকারী ব্যাংকটি একটি বিদেশি ব্যাংক। বাংলাদেশে একক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে যারা বেশি মুনাফা করে, তারাও বিদেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। আমরা সক্ষমতা আর দুর্বলতার কথা বলে আমাদের ব্যাংক ও ব্যবসাকে নিজ নামে বিদেশে না পাঠালে আমরা কখনোই সক্ষম হব না। তাই আমাদের ব্যাংক ও ব্যবসাকেও নিজ নামে ও নিজস্ব মূলধন নিয়ে বিদেশে যাওয়ার অনুমোদন দেওয়া প্রয়োজন। এর ফলে ব্যাংক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে, উচ্চপদে কাজেরও সুযোগ পাবে।

পরিশেষে বলতে হয়, আমাদের আচরণ, আইন ও নীতি এবং টেকনোলজি সংস্কার করে রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে কাঠামোগত সংস্কার সম্ভব। মনে রাখবেন, রেমিট্যান্স বাড়ানো না গেলে দেশের মানুষের জীবনমান বিপদের মধ্যে পড়বে এবং আমাদের যেহেতু আমদানির পরিমাণ অনেক বেশি, তাই অতিমাত্রায় মুদ্রাস্ফীতি হওয়ার আশঙ্কাও প্রবল। অতি মুদ্রাস্ফীতি প্রতিটি দেশের অর্থনীতিকে অস্বাভাবিক রকম অস্থির করে ফেলে।
লেখক: মো. মশিউর রহমান, ব্যাংকার