কপোতাক্ষ পরিকল্পনা: যেভাবে একটি শহরের চেহারা পরিবর্তন করবে
কপোতাক্ষ নদের কথা এলে মাইকেল মধুসূদন দত্তের চিত্র মানসপটে ভেসে উঠবে। কবির জন্যই বৃহত্তর যশোর ও এই নদটি বিশেষ একটি গুরুত্ব বহন করে। মৃতপ্রায় নদটি বাঁচাতে খননের কাজ করা হলেও আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায়নি। নদটি খননের মূলে ছিল নাব্যতা বজায় রেখে সারা বছর পানি ধরে রাখা, নদের দুই পাশে বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে প্রকৃতিক পরিবেশের উন্নয়ন। কিন্তু সারা বছর তো দূরের কথা, বর্ষার মৌসুমেও পানির অভাব দেখা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, নদ–নদী শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রতিবেশী দেশ ভারতের পানিকেন্দ্রীক রাজনীতি।
একসময় শহর-বন্দর, গ্রামগঞ্জ, হাটবাজার গড়ে উঠত নদ–নদী কেন্দ্র করে। কারণ, তখন যাতায়াতের বড় মাধ্যম ছিল পানিপথ। বড়দের মুখে শুনেছি, আমার জন্মস্থান ঝিনাইদহের মহেশপুরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কপোতাক্ষ নদ ঘিরে একসময় ব্যবসা–বাণিজ্য বিস্তার ঘটেছিল। পণ্য পরিবহন ও কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগে এ পথ ব্যবহার করা হতো। মহেশপুর দেশ ভাগের আগে পশ্চিম বঙ্গের বনগাঁ মহকুমার একটি অংশ ছিল। শিক্ষিত প্রভাবশালী হিন্দু জমিদারদের বসবাস ছিল এখানে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এই শহরটি পিছিয়ে পড়েছে। মূলত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা এবং ভৌগোলিক কারণ এর জন্য দায়ী। ফলে ব্যবসা–বাণিজ্য, শহরকেন্দ্রিক অবকাঠামো উন্নয়ন, যোগাযোগব্যবস্থা, শিক্ষা–সংস্কৃতি ও মানুষের জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে বেশ পিছিয়ে উপজেলা শহরটি। কিন্তু কপোতাক্ষ নদ ঘিরে পরিকল্পনা, শিক্ষা–সংস্কৃতিচর্চা, অবকাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে এ জনপদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব।
কপোতাক্ষ নদ এ জনপদের জন্য আশির্বাদ হলেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে যথাযথ ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। যুগোপযোগী পরিকল্পনার মাধ্যমে এই নদ ঘিরে কর্মসংস্থান, সবুজায়ন, পর্যটনকেন্দ্র, এডুকেশন হাব ও শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা সম্ভব। এ পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকাকেও।
অবস্থানগত কারণে মহেশপুর শহর পেছনে পড়ছে জেনেও উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক বা প্রশাসনিকভাবে শহর বা কপোতাক্ষ নদ ঘিরে কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। ফলে শহরটি বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বেশ বেগ পাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অপরিকল্পনা, অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতা। ফলে শত বছরের পুরাতন ছোট্ট শহরটি নিয়ে এখনই মাস্টার প্লান তৈরি করা না হলে ভবিষ্যতের আধুনিক বাংলাদেশ থেকে ছিটকে পড়বে।
শহর থেকে হাসপাতালে রোডে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভের উত্তর দিকে রাস্তা ও নদের মধ্যে বেশ খালি যায়গা আছে। এখানে দীর্ঘ পথের দৃষ্টিনন্দন ওয়াক ওয়ে নির্মাণ করা যায়। এতে সকাল বিকেল মানুষ শরীরচর্চা করতে পারবে। পাশে ছোট একটি প্লে গ্রাউন্ড থাকবে যেখানে বাচ্চা খেলবে। তৈরি করতে হবে ইনডোর স্টেডিয়াম ও জিমনেশিয়াম। থিয়েটার কাম কনফারেন্স হল ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চের আদলে মুক্তমঞ্চ নির্মাণ করে সংস্কৃতিচর্চা বেগবান করা যায়। থাকবে লাইব্রেরি ও ফুড কোর্ট। লেখক, পাঠকদের উজ্জীবিত রাখতে নিয়মিত সাহিত্য আড্ডা ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করতে হবে। নির্মাণ করাতে হবে আধুনিক রেস্ট হাউজ ও দৃষ্টিনন্দন কটেজ। মুক্তমঞ্চ ও থিয়েটার হলে নিয়মিত সন্ধ্যাকালীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মানুষের মধ্যে সুষ্ঠু ধারার সংস্কৃতিচর্চার ব্যবস্থা করা যাবে। সঙ্গে দেশি–বিদেশি সিনেমা ও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন, ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা, ডিবেটসহ শিক্ষা–সংস্কৃতির প্রতিটি শাখার বিস্তারে ভূমিকা রাখতে হবে। নদের অপর পারে ছোট পরিসরে একটি নদকেন্দ্রিক রিসোর্ট বানানো যায়। দুই পাড়ের সংযোগে দৃষ্টিনন্দন ঝুলন্ত ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে মহেশপুরের অবদান অনস্বীকার্য। মহেশপুরের কৃতিসন্তান বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের নামে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও গবেষণাকেন্দ্র তৈরি করতে হবে। পৌর ভবনের সামনের বাইপাস সড়কে নদের ধারে ওয়াক ওয়ে ও বৈকালীন বসার যায়গা এবং সন্ধ্যার পরে ফুচকা চটপটিসহ ফাস্ট ফুড–জাতীয় খাবারের ভ্রাম্যমাণ দোকান বসানো যায়। রাজশাহী শহরের পদ্মার পাড়ের আদলে সৌন্দর্য বর্ধন করে মানুষের মধ্যে আকর্ষণ তৈরি করতে হবে। যেহেতু মহেশপুর শহরের মধ্যে যায়গা কম, ফলে নদের ধার ঘেঁষে চমৎকার একটি পরিবেশ পাবে মানুষ। নদের অপর দিকে মহেশপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের পাশে শিক্ষা ও গবেষণাকেন্দ্র তৈরি করতে হবে। এখানে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে সাধারণ ও ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন ভাষার ওপর ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
এ ছাড়া, শহরের মধ্যে সরু রাস্তা প্রশস্তকরণ ও ড্রেনেজব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। মহেশপুর থেকে যশোর সড়কটি মহাসড়কে রূপান্তর, রেলপথ নির্মাণ, আঞ্চলিক মহাসড়কের উন্নয়ন, শহরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামো উন্নয়নে বিল্ডিং কোড মেনে চলা, সাপ্তাহিক হাট ও মাছের আড়ত অন্যত্র স্থানন্তর, পার্শ্ববর্তী শহর ও ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ উন্নয়নে আধুনিক টার্মিনাল নির্মাণ, উপজেলা পরিষদে নতুন নতুন বিল্ডিং নির্মাণ, কর্মসংস্থানের জন্য নদ ঘিরে পশুপাখি পালন ও কৃষি কাজ, শহরের পাশে স্মার্ট কৃষি মার্কেট নির্মাণ, বৃক্ষ রোপণ, ব্যবসা–বাণিজ্যের প্রসারে আধুনিক মার্কেট তৈরি, ছোট–বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের মাধ্যমে শহরকে আকর্ষণীয় কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে। এতে শহরে মানুষের সমাগম ঘটবে, যা শহরের রূপ পরিবর্তন করবে। ব্যবসা-বাণিজ্য, সর্বক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা, শিক্ষা–সংস্কৃতি ও বিনোদনব্যবস্থার মাধ্যমে কপোতাক্ষ নদ ঘিরে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও পরিপূর্ণ সুফল বয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে করবে।
লেখক: মো. শাহিন রেজা, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]