জীবন উদয়াস্তে মহাকালের সমীকরণ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কন্যার জন্মদিন উপলক্ষে জমাটি পার্টি দিলাম...আহা! কন্যা আমার আরও একটি বছর এগিয়ে গেল। দেখতে দেখতে সেই ছোটটি থেকে বড় হয়ে যাচ্ছে। বড়ই আনন্দের বিষয়। কিন্তু আসলেই কি এতটা আনন্দের?

  ‘ক্ষণে ক্ষণে ফুরায়ে আসিতেছে বেলা

 তবে মানিয়া লইতে কেন এত হেলা’

 প্রতিবছর জীবন থেকে একটি বছর করে আয়ু কমছে, সংকীর্ণ হয়ে আসছে জীবনসীমা, বরাদ্দকৃত আয়ুষ্কাল থেকে দিনগুলো যাচ্ছে চলে কেক কেটে তা উদ্‌যাপন করছি!

অবশ্য এই ভাবনা যদি অহর্নিশ এতই পোড়ায়, তবে যেদিন সে জন্মেছিল, সেদিনও তো হাসতে পারতাম না। প্রত্যেক জন্মই একটি নিশ্চিত মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে হাজির হয় জেনেও যে মহাকালের এই নিয়ম কেউ মনে রাখি না। তবে একেবারে বিস্মৃত হইনি, সেটা অস্বীকার করা অসম্ভব। এ যে আমাদের পুত্র–কন্যারা বড় হচ্ছে আমরা হচ্ছি বুড়ো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে আর চমৎকৃত হওয়া যায় না। কয়েক দশকের পুরোনো চেহারাটা আজকাল বিরক্তি ধরিয়ে দেয়। আরও কিছু বছর পেরোলে রং দিয়ে চুলের আসল রূপ ঢাকতে হবে। রংচঙে কাপড় পরে বয়স কমানোর ব্যর্থ চেষ্টায় অবতীর্ণ হতে হবে। তা–ও কী করে নিশ্চিন্তে ভুলে বসে আছি। জানি, এসব ভাবতে কারোরই ভালো লাগে না। ছেলেমেয়েরা যেমন বেঁচে আছে, আমিও তেমন বেঁচে আছি। তাদের আর আমার যাপিত জীবনে কোনো ফারাক তো দেখি না। কিন্তু...আসলে কি তাই? চোখের সামনে নিজের যুবতী মা আর হ্যান্ডসাম বাবার বুড়ো হয়ে যাওয়া দেখতে হচ্ছে, এ–ও তো কম কষ্টের না। ছেলেমেয়েরা দুই মিনিট দূরে থাকে না, পুরো দিন আঠার মতো গায়ে লেগে থাকে...ভীষণ একঘেয়ে লাগে...এই তো বছর কয়েক আগে আমার মা ও এমন একঘেয়ে জীবনে হাঁপিয়ে যেত। সারা দিন ছেলেমেয়েদের পেছনে ছুটে দম ফেলার ফুরসত পেত না। তাঁর শরীর–মন চাইত একটু বিরতি। তিনি এখন দুহাত ভরে সন্তানদের শুধুই একটু কাছে চান। মনে জানি, বিরতিহীন বিরতিতে বড্ড একা হয়ে পড়েছেন। সন্তানদের পেছনে দুদিন ছুটতে পারাটাই যে এখন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বিনোদন। মা তাঁর নিজের স্মৃতি বয়ান করে জানাযন, একসময় তাঁর মা–ও এভাবেই কাছে ডাকতেন! কিন্তু নিজের সংসার ছেড়ে একডাকে ছুটে যাওয়া তাঁর জন্য কঠিন ছিল, কখনো কখনো অসাধ্যও ছিল। দিন যায়, বছর যায়, একসময় মাকে ডাকার মানুষটি হারিয়ে যায়। চাইলেও আর ডাকার মতো কেউ থাকে না। আহা...প্রকৃতির কী অদ্ভুত চক্রাকার পরিণতি! আমি ও কি সেই অবশ্যম্ভাবী পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি না? ইতিহাস ঘুরেফিরে আবার আসে, নতুন মলাটে পুরোনো কাহিনি লিখতে হয়।

লেখক
ছবি: সংগৃহীত

জাগতিক এই ছেদহীন রীতি পাশ কাটানোর উপায় নেই। তথাপি মা–বাবার চলে যাওয়ার সহ্য করার মতো শক্তি কখনো সঞ্চয় কেউ করতে পারে বলে তো মনে করি না। অবশ্য কার আগে কে–ই বা চলে যায়, সেটাও নিশ্চিত বলা যায় না। নিজের জন্যে নির্ধারিত আয়ুর সময়সীমা জানা তো নেই কারও। মাথার ওপর অবধারিতভাবে ওত পেতে থাকা মৃত্যু বয়সের হিসাব মিলিয়ে আসে না কখনোই।

 লেখক: নুসরাত রহমান, শিক্ষার্থী, কবি নজরুল সরকারি কলেজ