করতোয়া নদী আর প্রিয় ছাগল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

২০২০ সালের ডিসেম্বর মাস। আমি পঞ্চগড়ে চাকরি করি তখন। অভ্যাস মতো হাঁটতে বের হয়েছি সেদিন। হাঁটি নদীর ধারে ধারে। হাঁটতে হাঁটতে কখনো বালুকাময় নদীতে পা ডুবাই। নদী মাঠ আর আকাশের মিতালি দেখতে দেখতে বেলা কেটে যায়। করতোয়া নদী।

পঞ্চগড়ে থাকাকালে সিকিম পর্বত থেকে নেমে জলপাইগুড়ির ভেতর দিয়ে হাটিহাটি করে টুপ করে পঞ্চগড়ে ঢুকে যাওয়া এই নদীটির সঙ্গেই ছিল মূলত আমার সম্পর্ক। শুধু সম্পর্ক বললে ভুল হবে—এই নদী ছিল আমার আত্মার আত্মীয়, মন, প্রাণ—সবকিছু।

করতোয়ার সঙ্গে আমার ভালোবাসাটা কেমন ছিল, তা আসলে বোঝানো যাবে না। অদৃশ্য এক সুতায় বাধা হৃদয়ের টান।

এটা অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্য যে আমি প্রায় সকাল–বিকাল গোসল করতাম এই নদীতে। গোসল বলতে মাখামাখি। বালু  আর জলের সঙ্গে  প্রেম বিনিময়। করতোয়া নদীতে কাদা নেই তেমন। আছে  বালু, পাথর আর স্বচ্ছতোয়া জলরাশি। দূষিত পানি নেই, নেই কোনো জলজ পানা।

দূষিত পানি নেই বলতে পানি দূষিত হওয়ার সুযোগই পায়নি এখানে। পর্বতের পেট থেকে বের হয়ে উদার আকাশের নিচ দিয়ে প্রকৃতির বুক চিরে ফাঁকা মাঠের ভেতর দিয়ে সোজা চলে এসেছে পঞ্চগড়ে। শহরের নালা–নর্দমার সঙ্গে পরিচয় হয়নি এই পঞ্চগড় আসা পর্যন্ত। এ জন্য করতোয়া এত সচ্ছ, এত টলটলে।

অনেক বালু, পাথরশ্রমিককে আমি আজলা ভরে পানি খেতে দেখেছি এই করতোয়া থেকে।

সাত সকাল হতেই শত শত নারী–পুরুষ পাথর আর বালু তোলে করতোয়া থেকে। সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য! অবসর সময়ে আমি পাথরশ্রমিকদের সঙ্গে আড্ডা জমাই। গল্প করি।

গল্পের নেশা আর নদীর টানে তাই সময় পেলে হাঁটতে যাই আমি।

আদালত থেকে সোজা পশ্চিম দিকে মকবুলার রহমান সরকারি কলেজ পার হলে রামের ডাঙ্গা, রামের ডাঙ্গার বড় মাঠ পার হলেই করতোয়া। বড় জোর ২০ মিনিটের হাঁটা পথ।

নাগরিক সংবাদ-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

সেদিনও আমি রামেরডাঙ্গা দিয়েই নদীতে যাচ্ছিলাম।
বাঁশের চাটাই, টিন আর কাদা মাটি দিয়ে তৈরি ছোট ছোট বাড়ি গুলি পাশাপাশি আত্মীয়র মত মিলেমিশে একটা পাড়া তৈরি করেছে। এই পাড়ার নামই রামেরডাঙ্গা। পঞ্চগড়ের দরিদ্র পাড়াগুলোর মধ্যে রামেরডাঙ্গা একটি।
ছোট ছোট চা–বাগান আর বাঁশঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে নিচু জমি। জমিতে বাঁধা গরু ছাগল। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি একটা ছাগলের ঠ্যাং দিয়ে রক্ত পড়ছে। ভালো করে দেখি কামড়ের দাগ। থমকে দাঁড়াই ।

ছাগলটার কি হয়েছে, তা পাশে দাঁড়ানো মাঝবয়সী এক মহিলার কাছে জানতে চাই। ছাগলটিকে কুকুরে কামড় দিয়েছে, তা এই রমণীর মুখে জানতে পারি।
ছাগলটা কার আপা?
‘নাহার আপার ছাগল’—উত্তর দেয় রমণী।
বাড়ি কোথায় নাহার আপার?
তিনি হাতের ইশারায় দূরে একটা বাড়ি দেখিয়ে দেন আমাকে।
ইশারায় দেখানো বাড়ি নিশানা করে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই দরজা অব্দি।
টিনের বেড়া আর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটা বাড়ি। বাড়ি বলতে দুটো ঘর। অনেক সাহস সঞ্চয় করে দরজায় ঠকঠক করি।
নাহার আপা বাড়িতে আছেন?
অনেকক্ষণ পর নাহার আপা বেরিয়ে আসে।
ছাগলের সবিস্তার জানতে পারি তার মুখে। মাত্র এক দিন আগে কুকুরে কামড়িছে ছাগলটাকে। পাগলা কুকুর কি না, ঠিক জানে না।
টিকা দেননি আপা?
আমরা গরিব মানুষ। টিকা কোথায় পাব?
নাহার আপার সোজা উত্তর।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করতে বলি তাকে। তিনি এসব অফিস টফিস চেনেন না। ঝামেলা ঝক্কির কারণে টিকা দেওয়ার বিষয়ে অত জরুরত নেই তার, আমি বুঝতে পারি তা।

দরিদ্র এই নারীর দুটি ছাগল অন্যতম সম্বল। আমি ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছি সেটা।
মনের অজান্তে বাম হাত মাথায় দিয়ে দুইবার চুলকাই। চট করে গুগল থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাকে ফোন করি। বিনয়ের সঙ্গে সবিস্তার ঘটনা জানাই তাকে।

এই নারী অতিশয় দরিদ্র এবং ছাগল নিয়ে অফিসে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই তার জেনে তিনি অফিস থেকে লোক পাঠান টিকা দেওয়ার জন্য।
এভাবে কয়েক দিন চলে টিকা।

অসুস্থ আত্মীয়র মতো ছাগলটিকে দেখার জন্য মন ছটফট করে আমার।
কয়েকদিন পরে দেখতে যাই ছাগলটা। দেখি-দিব্যি মাঠে ঘাস খেয়ে বেড়াচ্ছে।
ঘা অনেকটা শুকিয়ে গেছে।
নাহার আপা বারবার আমার পরিচয় জানতে চায়। টিকা দেওয়া লোকটা নাকি এসে জানতে চেয়েছে আমি তার কী হই?
অনেক জোরাজোরির পর বরাবরের মতো আমি নিজেকে খাদেম বলে পরিচয় দেই।
‘আপনি কোথাকার খাদেম মসজিদ না মাদ্রাসার?’
জানতে চায় নাহার আপা।
এবার সত্যি সত্যি বিপাকে পড়ি আমি।

আমাদের আদালতটা মসজিদের পাশে। আরবি তাওরিয়ার মতো করে কৌশলে বলি ওই মসজিদের পাশেই খাদেমগিরি করি আর কি?
মুখভর্তি লম্বা দাড়ি আর পরনে পায়জামা পাঞ্জাবি দেখে নাহার আপা অনেকটা আশ্বস্ত হয়। আমি খাদেম এই বিশ্বাস জন্মে তাঁর।

এই ঘটনার পর বেশ কয়েকবার ওই পথ দিয়ে করতোয়ায় গিয়েছি আমি।
অনেকবার দেখা হয়েছে প্রিয় ছাগলটার সাথে। এক দিন হাতে ধরে ঘাসও খাইয়েছি। বেশ কিছুদিন পর গিয়ে দেখি ছাগলটা বেশ নাদুসনুদুস হয়েছে। পেটে বাচ্চা।
তারপর অনেক দিন যায়নি সে পথে। প্রায় পাঁচ ছয় মাস পরের ঘটনা। পড়ন্ত বিকেলে নদীর দিকে হাঁটতে যাওয়ার পথে  থমকে দাঁড়াই। তাকিয়ে দেখি ছাগলটার বাচ্চা হয়েছে।

দুটি বাচ্চা নিয়ে ঘাস খাচ্ছে মাঠে। বাচ্চাদের মুখে মুখ লাগিয়ে কি যেন বলছে কানে কানে। কান পেতে আমি সে বোবা শব্দ শোনার চেষ্টা করি।
আনন্দের আতিশয্যে কোলে নিতে চাই বাচ্চাদুটো। দৌড়ে পালায়।
মা ছাগলটা আমার কাছে আসে। আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। নির্বাক প্রাণীর মতো। মনে হয় আমাদের দুজনের ভাষা এক হয়ে গেছে।
কী যে ভালো লাগে আমার!

পঞ্চগড় থেকে চলে এসেছি, সেই অনেক দিন হলো।
এখনো মনে আছে সেই আলপথ, মাঠ, ধানখেত, চা–বাগান আর করতোয়া নদী।
মনষচক্ষুর সামনে দিয়ে প্রতিদিন উল্টে যায় হাজারো পাতা। উল্টানো পাতায় পাতায় আমি করতোয়া নদী দেখি, স্মৃতির অংশ হয়ে থাকা প্রিয় ছাগলটাকে দেখি অপলক...

লেখক: সিনিয়র সহকারী সচিব, আইন মন্ত্রণালয়