‘একজন মায়ের রক্তে লেখা শহরের নির্মমতা’
ঢাকার মতো জনবহুল শহর এখন শুধু কর্মব্যস্ততার নয়, ভয় আর আতঙ্কেরও নগরী হয়ে উঠছে। প্রতিদিন কেউ না কেউ ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন—কখনো মোবাইল, কখনো ব্যাগ, কখনো প্রাণ। কিন্তু ৫০ বছর বয়সী এক মায়ের রক্তাক্ত চিৎকার যেন নতুন করে প্রশ্ন তোলে—আমরা আসলে কোন পথে যাচ্ছি?
হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার মিয়াখানি গ্রামের ফাতেমা বেগম—একজন সাধারণ গ্রামীণ নারী। গত রোববার (২ নভেম্বর) রাত ৮টার দিকে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটের বরগাছি এলাকা থেকে একটি বাসে করে ঢাকায় রওনা দেন।
গাজীপুরের টঙ্গী ফ্লাইওভারের ওপর রাতের অন্ধকার দূরীভূত হয়ে সকাল হয়ে আসছিল, আর ঠিক তখনই শুরু হয় তাঁর জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়। পরদিন সোমবার (৩ নভেম্বর) ভোর ৫টার দিকে টঙ্গী ফ্লাইওভারের ওপর বাস পৌঁছালে চালক, চালকের সহকারী, সুপারভাইজার—যাঁদের দায়িত্ব যাত্রীকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া, তাঁরাই নাকি প্রথমে তাঁকে বাস থেকে জোর করে নামিয়ে দেন। তারপর তিন ছিনতাইকারী এসে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুহূর্তেই কেটে যায় তাঁর হাতের রগ, ছিনিয়ে নেয় স্বর্ণালংকার, টাকা, ফোন—সবকিছু। এক নারী, এক মা, মাঝরাস্তায় রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকেন।
ভাবুন তো, কতটা অসহায় ছিল সেই মুহূর্ত?
হাতে রক্ত ঝরছে, ব্যথায় কাতর এক মা হয়তো শুধু একটাই কথা বলছিলেন—‘বাঁচাও!’ কিন্তু এই শহর বাঁচাতে জানে না। এই শহর ব্যস্ত—নিজের কাজে, নিজের গন্তব্যে।
পথচারী এক অচেনা মানুষ অবশেষে মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেন। সেই মানুষই তাঁকে উদ্ধার করেন এবং ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। ফাতেমার ছেলে শিপন—একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কুমিল্লা থেকে ছুটে আসেন মায়ের কাছে। কল্পনা করুন সেই মুহূর্তটি—অস্ত্রোপচার কক্ষের সামনে অপেক্ষায় থাকা এক ছেলের চোখে শুধু অশ্রু, মায়ের কষ্ট আর অসহায় রাগ।
এ ঘটনার দায় কাদের? শুধু তিন ছিনতাইকারী? না, আমাদেরও। আমরা সমাজ হিসেবে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, যদি একজন নারী নিরাপদে এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে না পারেন?
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
বাসের নাম ‘ম্যাক্স’। অথচ সেই ‘ম্যাক্স’ বাসই পরিণত হলো ভয়ংকর ফাঁদে। যারা তাঁর কাছ থেকে জীবনের নিরাপত্তা ছিনিয়ে নিল, তারা এখনো হয়তো অবলীলায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ঢাকার আলোঝলমলে ফ্লাইওভারগুলো কি আসলে ঢেকে রাখছে মানবতার অন্ধকারকে? যেখানে সাহায্যের হাতের বদলে দেখা যায় মোবাইল ক্যামেরা—সেই সমাজে আমরা নিরাপদ কাকে বলব?
ফাতেমা বেগম এখন ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর হাতের রগ কাটা, কিন্তু তাঁর আত্মা এখনো অটুট। এক মায়ের বেঁচে থাকার লড়াই চলছে। কিন্তু এ ঘটনার প্রতিটি রক্তের ফোঁটা আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ আর প্রশাসনের বিবেককে প্রশ্ন করে—
কেন এখনো ছিনতাইকারীরা রাস্তায়?
কেন এখনো ‘যাত্রী নিরাপত্তা’ শব্দটি শুধু স্লোগানেই বন্দী?
কেন এক মায়ের রক্তে আমাদের শহর রঙিন হলো, অথচ আমরা নির্বিকার?
এই শহর হয়তো উন্নয়নের গল্প বলে, কিন্তু তার ভেতরে লুকিয়ে আছে ফাতেমা বেগমের মতো অসংখ্য রক্তাক্ত মা, বোন আর মেয়ে। তাদের জন্য একদিন যদি আমরা সত্যিই কাঁদি, যদি একবারও মনে করি ‘তিনিও কারও মা’, তাহলে হয়তো মানবতা নামের শব্দটা আবার ফিরবে আমাদের মধ্যে।
লেখক: মো. আবু হানিফ বিন সাঈদ