বইমেলা কি শুধুই সেলফি তোলার জায়গা
বইমেলা—শব্দটির সঙ্গে একধরনের আবেগ, ভালোবাসা ও সাংস্কৃতিক চেতনাবোধ জড়িয়ে আছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি গভীর মমত্ববোধ থেকেই বাংলা একাডেমি ১৯৭২ সালে অমর একুশে বইমেলার যাত্রা শুরু করে। এরপর এটি শুধু বই কেনাবেচার জায়গা নয়, বরং বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে—বইমেলা কি এখন শুধুই সেলফি তোলার জায়গায় পরিণত হয়েছে?
প্রযুক্তির এই যুগে মানুষ এখন স্মার্টফোনে অনেক বেশি সময় কাটায়। সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে ছবি আপলোড করা যেন দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। বইমেলাও এর ব্যতিক্রম নয়। মেলায় প্রবেশ করলেই দেখা যায়, অনেকেই বইয়ের স্টল ঘুরছেন, কিন্তু তাদের প্রধান উদ্দেশ্য বই কেনা নয়, বরং সুন্দর লোকেশনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা ও তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা।
বইমেলায় প্রবেশ করলেই বোঝা যায়, ভিড় আছে, কিন্তু সবাই বইপ্রেমী নয়। অনেকেই এসেছেন শুধুই ঘুরতে, ছবি তুলতে এবং সময় কাটাতে। বিশেষ করে সন্ধ্যার দিকে মেলায় ভিড় অনেক বেড়ে যায়, তখন স্টলে প্রবেশ করা বা বই দেখা কঠিন হয়ে পড়ে। স্টলমালিকদের অভিযোগ, অনেক দর্শনার্থী শুধু ছবি তুলেই চলে যান, কিন্তু বই কেনেন না। এমনকি নতুন লেখকদের বই হাতে নিয়ে ছবি তুলে পরে সেটি না কিনে রেখে দেওয়া একটি সাধারণ দৃশ্য হয়ে উঠেছে। অবশ্যই বইমেলা শুধু বই কেনাবেচার জায়গা নয়, এটি সাহিত্যপ্রেমীদের মিলনমেলা। কিন্তু যখন বইয়ের চেয়ে সেলফির গুরুত্ব বেশি হয়ে যায়, তখন বইমেলার মূল উদ্দেশ্য যেন কিছুটা হারিয়ে যায়। অনেক প্রকাশক মনে করেন, বইমেলায় দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়লেও বিক্রি আশানুরূপ নয়। একদিকে বইয়ের দাম বেড়েছে, অন্যদিকে পাঠকদের একটি বড় অংশ শুধু মেলায় ঘুরতে আসছেন, কিন্তু বই কিনছেন না। বই বিক্রেতারা অভিযোগ করেন, এখন বইমেলা যেন বই বিক্রির জায়গার চেয়ে বিনোদনের জায়গায় পরিণত হয়েছে। নতুন লেখকদের জন্য এটি আরও হতাশার। একজন নবীন লেখক যখন তার বইয়ের স্টলে দাঁড়িয়ে দেখেন, অনেকে শুধু বই হাতে নিয়ে ছবি তুলে রেখে দিচ্ছেন, তখন সেটি লেখকের জন্য বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। বই বিক্রি কম হওয়ায় অনেক প্রকাশক ক্ষতির মুখে পড়েন, যা ভবিষ্যতে বই প্রকাশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সেলফি তোলা একটি আধুনিক প্রবণতা, যা বর্তমান প্রজন্মের অনেকের জীবনযাপনের অংশই হয়ে গেছে। এটি পুরোপুরি নেতিবাচক কিছু নয়। অনেক ক্ষেত্রে এটি বইমেলার প্রচারের জন্য ভালো ভূমিকা রাখে। মানুষ যখন মেলায় গিয়ে ছবি তোলে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে, তখন আরও অনেকেই বইমেলায় আসতে উৎসাহিত হন। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এতে আকৃষ্ট হয়। তবে সমস্যা হয় তখনই, যখন বইয়ের প্রতি মনোযোগ কমে গিয়ে শুধু বিনোদন ও সেলফির দিকটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। যদি দর্শনার্থীরা শুধু ছবি তুলেই চলে যান, বই কেনার আগ্রহ না দেখান, তাহলে সেটি বইমেলার মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে।
বইমেলার মূল আকর্ষণ হওয়া উচিত বই ও সাহিত্য। তাই বইমেলার কর্তৃপক্ষ এবং প্রকাশকদের কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে, যাতে দর্শনার্থীদের বই কেনার প্রতি আগ্রহ বাড়ে। শুধু বই বিক্রির ওপর জোর না দিয়ে সাহিত্যবিষয়ক আলোচনা, লেখক-পাঠক সংলাপ, কবিতা পাঠের আয়োজন বেশি করা উচিত। এতে দর্শনার্থীদের সাহিত্য বিষয়ে আগ্রহ বাড়বে। মেলায় যাঁরা সত্যিই বই কেনায় আগ্রহী, তাঁদের জন্য বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে পাঠক বই কেনায় আরও আগ্রহী হবেন। সেলফি কালচারকে পুরোপুরি বাদ না দিয়ে বরং সেটিকে বইমেলার প্রচারের অংশ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন ‘বই কিনে সেলফি দিন’ নামে ক্যাম্পেইন চালানো যেতে পারে, যেখানে দর্শনার্থীরা বই কেনার পর ছবি তুলে পোস্ট করলে পুরস্কার পেতে পারেন। যাঁরা মেলা থেকে বই কিনছেন, তাঁদের জন্য ‘বিশেষ পাঠক সদস্যপদ’ দেওয়া যেতে পারে, যা ভবিষ্যতে আরও ছাড় ও সুযোগ দেবে। এতে পাঠকদের বই কেনার প্রতি আগ্রহ বাড়বে।
বইমেলা শুধু ঘোরাঘুরি, আড্ডা বা সেলফির জন্য নয়, এটি বই ও জ্ঞানের মেলা। বিনোদন থাকা দরকার, কিন্তু বইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও আগ্রহ থাকা আরও জরুরি। আমাদের সবার উচিত, বইমেলায় গিয়ে শুধু ছবি তোলার চেয়ে অন্তত কিছু বই কেনা, নতুন লেখকদের উৎসাহ দেওয়া এবং বই পড়ার সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করা। তাহলেই বইমেলা তার প্রকৃত উদ্দেশ্য সফলভাবে পূরণ করতে পারবে।
লেখক: জাফরিন সুলতানা, শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়