যেমন দেখলাম কাতার বিশ্বকাপ

পর্দা নামল কাতার বিশ্বকাপ ২০২২–এর। সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে আর কোটি কোটি সমর্থকের অদম্য বিশ্বাস, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণতা দিয়ে ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হলো। ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরাদের একজন, মহাতারকা লিওনেল মেসির হাতে উঠল স্বপ্নের সোনালি ট্রফি। একঝাঁক তরুণ আর অভিজ্ঞ খেলোয়াড় নিয়ে গড়া আর্জেন্টিনা বিশ্ববাসীকে ‘টিম স্পিরিট’, ‘টিম ওয়ার্ক’ দিয়ে কীভাবে সবকিছু জয় করা যায়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ রেখে গেল। চারদিকে এখন একটাই কোলাহল ‘ভামোস আর্জেন্টিনা!’ ‘ভামোস মেসি!’

২০ নভেম্বরে কাতার-ইকুয়েডরের ম্যাচ দিয়ে শুরু হয় বিশ্বকাপ ফুটবল। দুই দলের মধ্যে সব দিকে এগিয়ে থাকা ইকুয়েডর ম্যাচ জিতে নেয় ২-০ গোলে। ২১ তারিখ থেকে জমে ওঠে খেলা। এশিয়ার ফুটবল পরাশক্তি  ইরানকে ৬-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে ইংল্যান্ড দেখিয়ে দেয় কেন তাদের এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম হট ফেভারিট ভাবা হচ্ছিল। পরের দিন অঘটন! সৌদি আরবের কাছে ২-১ গোলে ফুটবল পরাশক্তি আর্জেন্টিনার পরাজয়। প্রথম রাউন্ডেই বিদায়ে শঙ্কা-কারণ গ্রুপের অন্য দুই দল যে মেক্সিকো ও লেভান্ডফস্কির পোল্যান্ড! খেলা চলতে থাকে। এর মধ্যেই অন্যতম ডার্ক হর্স, ধারাবাহিকভাবে বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলা ক্রোয়েশিয়াকে রুখে দিয়ে সবার নজরে আসে মরক্কো। বিশ্বকাপের আগে বেনজেমা, পগবা, কিপেম্বেবিহীন ফ্রান্সকে একটু খর্বশক্তির লাগলেও তারা যে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন তা প্রথম ম্যাচেই আবার সবাইকে আবার মনে করিয়ে দেয়। র‍্যাবিও আর এমবাপ্পের এক এক গোলের পাশাপাশি অলিভিয়ের জিরু জানান দেন তিনি ফরোয়ার্ড হিসেবে ফ্রান্সের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার। করেন দুই গোল। ফলাফল ৪-১ গোলে বিজয়ী ফ্রান্স। ওদিকে জার্মানির অভিশাপ যেন কাটছেই না। জামাল মুসিয়ালা, কাই হাভার্টজ, থমাস মুলারদের জাপান থামিয়ে দেয় ২-১ গোলে ম্যাচ জিতে। অসাধারণ ফুটবলে তারা পরাজিত করে চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের। পরের দিন কোস্টারিকার জালে স্পেনের গোল–উৎসব! রীতিমতো ছেলেখেলার ম্যাচটি স্পেন জেতে ৭-০ গোলে! ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল মাঠে নামে ২৪ নভেম্বর। ৩-১ গোলের জয় পাওয়া ম্যাচে পর্তুগিজ যুবরাজের পা থেকে আসে এক গোল। আগের ম্যাচে ভালো খেলেও ড্র উরুগুয়ে-দক্ষিণ কোরিয়া ম্যাচ। অর্ধেক পৃথিবী তথা বাংলাদেশির অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এরপর ব্রাজিল মাঠে নামে সার্বিয়ার বিপক্ষে। রিচার্লিসনের জোড়া গোলে ম্যাচ ব্রাজিলের। বাইসাইকেল কিকে রিচার্লিসন করেন বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা গোল।

দুদিন পর জমে ওঠা বিশ্বকাপে আবার উত্তেজনার বারুদ ছড়ায় মেক্সিকো আর্জেন্টিনা ম্যাচে। লিওনেল মেসি আর এনজো ফার্নান্দেজের গোলে বিশ্বকাপের লড়াইয়ে টিকে যায় আর্জেন্টিনা। পরের দিনই আবার অঘটন। জার্মানির বিদায়ঘণ্টা প্রায় বাজিয়ে দেওয়া জাপান কোস্টারিকার কাছে হেরে বসে ১-০ গোলে। ওদিকে মরক্কোর উত্থান তাক লাগিয়ে দেয় পুরো বিশ্বকে। লুকাকু, হ্যাজার্ড আর ডি ব্রুইনাদের বেলজিয়ামকে ২-০ ব্যবধানে পরাজিত করে তারা রাউন্ড অব সিক্সটিনের পথটা একরকম পরিষ্কার করে ফেলে। মুগ্ধ করে আলী যাইচ, আশ্রাফ হাকিমি আর ইয়াসিন বনুদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নেয় জার্মানি ও বেলজিয়ামের মতো হাই প্রোফাইল দল। চমক জাগিয়ে রাউন্ড অব সিক্সটিনে যায় জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও মরক্কো। রাউন্ড অব সিক্সটিনের অসাধারণ একটা ম্যাচ ছিল জাপান বনাম ক্রোয়েশিয়ার ম্যাচটি। দুর্দান্ত খেলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ওঠা জাপান পেনাল্টি শুট আউটে পরাজয় বরণ করে। অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ম্যাচ জিতে নেয় লুকা মদরিচের ক্রোয়েশিয়া।এরপর আবারও সেই মরক্কো! পেনাল্টি শুট আউটে হেরে ২০১০–এর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্পেনের বিদায়। গোলপোস্টের নিচে অসাধারণ পারফরম্যান্স দিয়ে ম্যাচসেরা হন ইয়াসিন বনু। ওদিকে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে ছাড়াই সুইজারল্যান্ডকে ৬-১ গোলে বিধ্বস্ত করে কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নেয় পর্তুগাল।

এরপর শুরু হয় কোয়ার্টার ফাইনালের জমজমাট লড়াই। ব্রাজিলের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে কাতার বিশ্বকাপের প্রথম দল হিসেবে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে ক্রোয়েশিয়া। ১০৬ মিনিটে করা নেইমারের অসাধারণ গোলে ব্রাজিল এগিয়ে যাওয়ার পর ম্যাচ শেষ হওয়ার মাত্র তিন মিনিট আগে ক্রোয়েশিয়ার পক্ষে সমতাসূচক গোল করেন ব্রুনো পেতকোভিচ। পুরো ম্যাচে গোলবারের অতন্দ্র প্রহরী ডমিনিক লিভাকোভিচ ১১টি  সেভ করেন। পেনাল্টি শুট আউটে আবার নায়ক সেই লিভাকোভিচ। কাঁদলেন নেইমার কাঁদল ফুটবলবিশ্ব। ঘণ্টা পেরোতেই তুমুল উত্তেজনার আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ডস ম্যাচ। ম্যাচের ভাগ্য আবার সেই পেনাল্টিতে। নায়ক যথারীতি আরেক গোলরক্ষক। কোপা আমেরিকার পর এমিলিয়ানো মার্তিনেজ বলেছিলেন, মেসির জন্য প্রাণ দিতে পারেন। তার পারফরম্যান্স দেখেই বোঝা গিয়েছে মেসির হাতে একটা বিশ্বকাপ ট্রফি তুলে দেওয়ার জন্য তিনি কতটা মরিয়া। ফলাফল আর্জেন্টিনা সেমিফাইনালে। ম্যাচ চলাকালে রেফারির ১৮টি হলুদ কার্ড দেখানো নিয়ে সৃষ্টি হয় তুমুল বিতর্ক । মরক্কোর চমক যেন থামেই না। পর্তুগালকে হারিয়ে এরপর সেমিতে মরক্কো। শুরুর একাদশে নেই রোনালদো। শেষ ১০ মিনিট আগে মাঠে নামলেও শেষ রক্ষা হয় না। কোটি ফুটবল অনুরাগীকে কাঁদিয়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নামের গ্রেট ফুটবলারটি ডাগ আউটে বসে তাঁর অসহায় চাহনি, ম্যাচ শেষে কান্না তাঁর হেটারদেরও যেন কাঁদিয়ে ছাড়ল। বিদায়টা যে মোটেও আশানুরূপ হলো না পর্তুগিজ যুবরাজের। ওদিকে মরক্কোর  রূপকথা লেখাই চলছে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে সেমিফাইনালে নাম লেখায় তারা। প্রতিপক্ষ ফুটবলের মহাশক্তিশালী ফ্রান্স। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে যারা  দুর্দান্ত ছন্দে। আগের ম্যাচে থিয়েরি অঁরিকে ছাড়িয়ে জাতীয় দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোলের নতুন রেকর্ড করা অলিভিয়ের জিরু এই ম্যাচেও গোল করেন। ফ্রান্সের দুটি গোলেই ছিল ঠান্ডা মাথার অসাধারণ খেলোয়াড় গ্রিজম্যানের অবদান।

সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে দাঁড়াতেই দেয়নি আর্জেন্টিনা। জুলিয়ান আলভারেজের জোড়া গোল আর মেসির পেনাল্টি লক্ষ্যভেদে আর্জেন্টিনা ম্যাচ জেতে ৩-০ ব্যবধানে। শিরোপার সোনালি ছোঁয়া পেতে আর মাত্র এক ম্যাচ। অপর ম্যাচে ফুটবলপ্রেমীদের মরক্কোর প্রতি বেশি সমর্থন থাকলেও প্রফেশনাল খেলে বিজয়ী ফ্রান্স। ফাইনালে এবার প্রতিপক্ষ বারুদ হয়ে জ্বলে ওঠা আর্জেন্টিনা, যাদের লক্ষ্যই হয়, শিরোপা জিততেই হবে।

আবার চার বছর পর ফিরে আসার বার্তা নিয়ে ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় শুরু হয় কাতার বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ। লুসাইল স্টেডিয়ামে ৩৬ বছর পর স্বপ্নের শিরোপার সাধ আবার পূরণ হয় আর্জেন্টিনার। শিরোপা উঁচিয়ে পূর্ণ হয় তার ক্যারিয়ার। তবে কিলিয়ান এমবাপ্পে জানান দিয়ে গেলেন তিনি আসছেন ফুটবল বিশ্ব শাসন করতে। ৬৬ বছর পর বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে হ্যাট্রিক করেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। ফাইনালের প্রথমার্ধেই আর্জেন্টিনা ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায়। ম্যাচের সত্তর মিনিট পর্যন্ত ম্যাচ মোটামুটি একপেশেই ছিল। ৯৮ সালের বিশ্বকাপজয়ী ফরাসি অধিনায়ক ও বর্তমান কোচ ক্ষুরধার মস্তিষ্কের দিদিয়ের দেশম শতকোটি দর্শককে তাক লাগিয়ে ম্যাচের ৭০ মিনিটেই তুলে নেন আক্রমণভাগের তিন প্রধান খেলোয়াড় জিরু, গ্রিজম্যান আর ডেম্বেলেকে। ম্যাচের গোলদাতা দি মারিয়াকে উঠিয়ে নিয়ে সামান্য গা–ছাড়া খেলা শুরু করে আর্জেন্টিনা। দেশমের কৌশল সফল। দেড় মিনিটের মধ্যে ফ্রান্সের দুই গোল পরিশোধ। গোলদাতা সেই এমবাপ্পে। খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ১০৮ মিনিটে মেসির অসাধারণ গোলের পর আবারও সেই এমবপ্পে। ডি বক্সে হ্যান্ডবল হলে পেনাল্টিতে ঠান্ডা মাথায় গোল করেন এমবাপ্পে। ততক্ষণে ২০০২–এ রোনালদো নাজারিও আট গোল করে গোল্ডেন বুট নিশ্চিত হয়ে যায় তাঁর। ম্যাচের মাত্র ৩০ সেকেন্ড আগে বিশ্বকাপের সেরা বলা চলে ফ্রান্সের থেকে বিশ্বকাপ ছিনিয়ে নেওয়া সেভ করেন সেই এমিলিয়ানো মার্তিনেজ।

খেলা গড়ায় পেনাল্টিতে। ত্রাতা আবার সেই গোলরক্ষক। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতল আর্জেন্টিনা। শেষ বিশ্বকাপে মেসি স্বর্ণাক্ষরে লিখলেন তাঁর অমর হয়ে থাকার ইতিহাস।

দ্বিতীয় বারের মতো গোল্ডেন বল পেলেন লিওনেল মেসি। এমবাপ্পে গোল্ডেন বুট, গোল্ডেন গ্লাভস এমি মার্তিনেজের আর এঞ্জো ফার্নান্দেজ জিতলেন সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরস্কার।

হর্ষ–বিষাদে ভরা এ বিশ্বকাপ ছিল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, লিওনেল মেসি, লুকা মদরিচ, থিয়াগো সিলভার মতো কিংবদন্তি খেলোয়াড়দের শেষ বিশ্বকাপ। এরপর বিশ্বকাপে আর দেখা যাবে না এডেন হ্যাজার্ড, লুকাকু, ফারনান্দো তোরেস, গুইলারমো ওচোয়াদেরও।

তবে উত্থান হলো জুলিয়ান আলভারেজ, এনজো ফার্নান্দেজ, ভিনিসিয়ুস, আশ্রাফ হাকিমিদের। সঙ্গে এমবাপ্পে হলেন পরবর্তী দশকের অলিখিত রাজা।

এক মাস ধরে চলা বিশ্বকাপ ছিল নিজের দেখা ষষ্ঠ বিশ্বকাপ এবং সেরা বিশ্বকাপ। তবে একটা বিষয় না বললেই নয়। এ যাবত  ছয়টা বিশ্বকাপ দেখেছি, তবে এবারের মতো সমর্থকদের উগ্রতা আগে চোখে পড়েনি। আগে মজা হতো, বেশ খানিকটা খোঁচাখুঁচি হতো, তবে সেটির একটা সীমা ছিল। এখন রাস্তাঘাটের লড়াই, খেলা নিয়ে হতাহত কিংবা যদি বলি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তি, দল, খেলোয়াড়দেরকে হেয় করা, তাদের নিয়ে অপমানজনক উক্তি এমনকি খেলা নিয়ে দ্বন্দ্ব ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টা খুব চোখে পড়েছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আশা করি এগুলোর অবসান হবে।

ছোট্ট একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করি। দি মারিয়ার খুব ভক্ত আর মেসির শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করলেও গত আট বছরের অযথা ‘সেভেন আপ’ বলে ত্যক্ত করা সমর্থকদের কারণে আর্জেন্টিনার দলের জন্য ভালোবাসা, খুব একটা ভালোবাসা ছিল। তবুও ফুটবল–ভক্ত হিসেবে তাদের দলটি ভালো করলে খারাপ লাগত না। আবার এটাও সত্য যে ব্রাজিলের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে রিভেলারি দলকে পুরোপুরি সাপোর্টও দিতে পারি না। তাই মজার ছলে কলিগদের বলেছিলাম যান, ফ্রান্স জিতলে আপনাদের ভিটাবাড়ির মিষ্টি খাওয়াবো! আজ সকালে আর্জেন্টিনার একনিষ্ঠ সমর্থক এক কলিগ বললেন, তমা মিষ্টি খাওয়াতে চাইল, একটুর জন্য মিস হয়ে গেল!  বললাম, ঠিক আছে আর্জেন্টিনা জিতেছে ফার্স্ট ক্লাস দুধ চা খাওয়াব। কথা রেখেছি। দোয়া নিয়েছি, যেন ব্রাজিল ২০২৬ সালে হেক্সা মিশন পূর্ণ করতে পারে!

যা–ই হোক, বিশ্বকাপের এক মাস খুব উপভোগ করলাম। এর সুখস্মৃতি থাকবে বহু দিন।