সমাজচিন্তনের নেপথ্য কথা
দিনটি ছিল ২০২২ সালের ২২ জুন, বৃহস্পতিবার। সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোরের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতল ভবনের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে মনে পড়ল—আজ থেকে ছয় মাস আগেও এ স্বপ্নটা কতটা অবাস্তব মনে হয়েছিল। আমাদের বিভাগ থেকে প্রথম আন্তর্জাতিক জার্নাল সমাজচিন্তন প্রকাশিত হবে। যার মোড়ক উন্মোচন করবেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। আজ ক্যাম্পাসে প্রবেশ আমার কাছে আর দশটা দিনের মতো নয়। দীর্ঘ সাধনার ফল লাভের এক মাহেন্দ্রক্ষণ।
কলেজ পর্যায়ে জার্নাল প্রকাশের কথা ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন বোনার সমান। নিজের মনের সুপ্ত বাসনার অঙ্কুরোদ্গম করার সুযোগ হাতছাড়া করতে আমি রাজি নই, তাই এ অসাধ্য সাধনের পথে নিজেকে সঁপে দিলাম।
লেখা জোগাড়ে ছিল কঠিন এক যুদ্ধ। কলেজ পর্যায়ে গবেষণাকাজ জোগায় না পদোন্নতি, না বেতন বৃদ্ধি, ফলে আগ্রহী শিক্ষকও হাতে গোনা। তবুও বিভাগের সহকর্মীদের নিয়ে আলোচনায় বসলাম। লেখার জন্য অনুরোধ করলাম। কেউ কেউ সামনে সরাসরি আপত্তি না জানালেও পরে লেখার তাগিদ দিলে কেউ বলেন, ‘স্যার সময় কই, খুব ব্যস্ত। নইলে স্যার, বসলেই ভালো লেখা দিতে পারতাম।’ দুঃখের বিষয় হলো, আমি অনেকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে, অনেকে আমার মুঠোফোনের কল ধরা বন্ধ করে দেন। অধ্যক্ষ আজীবন গবেষণার বাইরে থেকেছেন। তবুও বললেন, আপনার এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। শেষ রাত অবধি বসে তিনি নিজেই একটা প্রবন্ধ লিখে ধরিয়ে দিলেন। সাধারণত সম্পাদকের লেখা কোনো জার্নালে প্রকাশ না করাই শোভনীয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিতসংখ্যক লেখা না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে নিজেই একটি প্রবন্ধ ও গ্রন্থ পর্যালোচনা লিখি।
দুই সহকর্মীর যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও লিখছিলেন না। আমি জানি, তাঁদের মধ্যে সৃজনশীলতা আছে। অনেক চাপাচাপি করে তাঁদের কাছ থেকে লেখা আদায় করি। আমার মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা ক্লাসের বাইরে এসে সমাজ নিয়ে ভাবুক, এটাই চেয়েছিলাম। আমি গবেষণাধর্মী টার্ম পেপার তৈরি করতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের একটি দল নিয়ে যশোরের একটি গ্রামে ফিল্ড ওয়ার্ক করাই। সেখানে পাওয়া তথ্যাদি নিয়ে তারা একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। সেই প্রতিবেদনকে প্রবন্ধে রূপান্তর করা হয়। অবশেষে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানের বন্ধুদের কাছ থেকে লেখা পাওয়ার পর জার্নালটির সম্পাদনার কাজ শুরু করি।
‘নাগরিক সংবাদ’–এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]
তবে সমস্যা দেখা দেয় জার্নালটির প্রকাশনা ব্যয় নিয়ে। কলেজ পর্যায়ে এ ধরনের একাডেমিক প্রকাশনার কোনো ব্যবস্থা নেই, সহকর্মীদের আগ্রহও শূন্যের কোঠায়। বিভাগে টাকা নেই, অনুদান নেই ও সরকারি সহায়তা নেই। ঠিক করলাম যে স্বপ্ন নিজের, তার ব্যয়ভার নিজের হওয়া উচিত। ব্যয়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলাম। বিশেষ করে আমার প্রিয় সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের জন্য। কারণ, তাঁদের অনেকেই জানেন না যে জার্নাল কী? প্রবন্ধ কী? সংগ্রহ করা প্রবন্ধগুলো আমার কাছের কিছু শিক্ষক বন্ধুদের অনুরোধ করে রিভিউ করালাম। তাদের মধ্যে কেউ এখন ইউরোপে গবেষণা করছে, কেউ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। তাদের মন্তব্য ও পরামর্শ মেনে লেখাগুলো সম্পাদনা করলাম।
আইএসএসএন স্বীকৃতি আমার জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। শোনলাম, এই স্বীকৃতি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে নিতে হয়। মাথায় হাত! কত ই–মেইল করেছি, কত সাইট ঘেঁটেছি। অবশেষে খুঁজে পেলাম, বাংলাদেশের একজন প্রিমিয়াম মেম্বারকে, যিনি আগ্রহভরে সহায়তা করলেন। তাঁর মাধ্যমেই স্বল্প সময়ের মধ্যে স্বীকৃতি মিলল।
সবশেষে ছাপার কাজ শেষ হলে কলেজ অধ্যক্ষের সহায়তায় জার্নালটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। চেয়েছিলাম, কলেজের সব শিক্ষক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকুক, জানুক, বুঝুক—কী কাজ করেছি আমরা। জানুক, গবেষণা মানে শুধু বইয়ের পাতায় নয়, এটি সমাজের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার হাতিয়ার। অনুষ্ঠানে সবাই জার্নালের সম্পাদকের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। কেউ কেউ তো বলেই বসেন, ‘সম্পাদক এ কাজের একজন দক্ষ নাবিক...’। কিন্তু তাঁদের অনেকেই হয়তো জানতেন না কত প্রচেষ্টার মাধ্যমে জার্নালটি প্রকাশিত হলো।
আসলে শিক্ষকতা আমার পেশা। আর গবেষণা তথা লেখালেখি আমার নেশা। এ কাজেই আমার আনন্দ। তাই যে ধরনের প্রতিকূলতাই আসুক না কেন, এ কাজটি আমি চালিয়ে যেতে চাই। তাই তো ২০২৩ সালে জার্নালটির দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে এবং তৃতীয় সংখ্যার জন্য লেখা সংগ্রহের কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। এখন সম্পাদনার কাজ চলছে।
*লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর।