পারিসার সাহসিকতার উত্তর কোথায়

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পারিসা আক্তার
ছবি: সংগৃহীত

মেয়েটি অনেক বড় ঝুঁকি নিয়েছিল। ছিনতাইকারীদের সঙ্গে সাধারণত ব্লেড ও চাকু থাকে। বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হতে পারত। এ রকম ঝুঁকি নেওয়া একেবারেই নিরাপদ নয়। জান বাজি রেখে অপরাধীকে ধরা অনেক বড় বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতা। ভাগ্য ভালো, তার কোনো ক্ষতি হয়নি। রাজধানীর টিকাটুলিতে ছিনতাইকারী ধরতে গিয়ে তাদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ যায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটারবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবু তালহা খন্দকারের। আসলে মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিসের জন্য সংগৃহীত গবেষণা খোয়া যাওয়ার আশঙ্কায় নিজেকে সামলাতে পারেনি হয়তো। মোবাইল হারালে মোবাইল ফিরে পাওয়া যেত; কিন্তু জীবন গেলে সে জীবন আর ফিরে আসবে না। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুজন ছিনতাইকারীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মাস্টার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী পারিসা আক্তারকে ধন্যবাদ। সে সাহসের সঙ্গে একটি যুদ্ধ শেষ করে ইতিহাস হয়ে থাকল। এ থেকে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শিক্ষা নেওয়া উচিত। শিক্ষার্থীর সাহসী কাজকে আমরা সম্মান জানাই।

ছিনতাইকারীকে জাপটে ধরে বুকের ওপর চেপে বসে মারপিটের ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। এটা একমাত্র জ্ঞানহীন, অজ্ঞ মানুষের দ্বারাই সম্ভব। অথচ জবি শিক্ষার্থী পারিসা আক্তারের মুঠোফোন হারিয়ে শিশুর মতো অঝোরে কান্নার কষ্ট ওরা অনুভব করতে পারেনি। থিসিস বা গবেষণাকর্মের তথ্য-উপাত্ত, ডকুমেন্ট বা ফটো খোয়া যাওয়া যে কত বড় কষ্টের, তা শুধু জ্ঞানীরাই বুঝবেন। আইনের প্রতি অনাস্থা ও কতটা অসহায় হলে মানুষ এভাবে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে পারে। একজন ছিনতাইকারীর জন্য অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। এমনকি অনেক নিরীহ মানুষ মারা যায়। দূরপাল্লার বাস, ট্রেন বা লঞ্চ থেকে রাজধানীতে নেমেই তিক্ত ও ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় অনেক মানুষকে।

ছিনতাইকারীরা নারীদের গলার চেইন ছিনতাই, কান ছিঁড়ে গয়না নেওয়া, হ্যাঁচকা টানে নারীদের পার্টস ছিনতাইয়ে নারীদের পড়ে যাওয়ার পর মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে। এই তো মাত্র কয়েক দিন হলো, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র বুলবুল আহমেদ নামের এক শিক্ষার্থী ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। ৭ জুলাই রাজধানী ঢাকার অদূরে আবদুল্লাহপুর ব্রিজের কাছে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে নির্মাণশ্রমিক মো. সাহেদ নামের এক যুবক নিহত হয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, ছিনতাইকারীরা সাহেদকে ছুরি মেরে খুনের পর তার কাছে থাকা টাকা ও মুঠোফোন নিয়ে গেছে। গত ২৭ মার্চ রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে বুলবুল হোসেন নামের এক ডেন্টাল চিকিৎসক নিহত হয়েছেন। যে ঘটনায় দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় ওঠে। চিকিৎসক বুলবুল দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দিতেন। শুধু স্বাবলম্বীদের কাছ থেকে ফি নিতেন। ইতিপূর্বে রাজধানীর দয়াগঞ্জ এলাকায় ছিনতাইকারীদের হ্যাঁচকা টানে মায়ের কোল থেকে পড়ে মারা যায় ছয় মাস বয়সী আরাফাত। একইভাবে ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে মারা যান জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ফরহাদ আলম।

৫ মে ২০২১ সকাল ছয়টার দিকে রাজধানীতে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে মুগদা বৌদ্ধমন্দিরের পরিচ্ছন্নতাকর্মী সুনিতা রানী দাসের মৃত্যু হয়েছিল। সুনিতা তাঁর বোনের ছেলে সুজিতকে সঙ্গে নিয়ে রিকশায় করে বৌদ্ধমন্দিরে যাচ্ছিলেন। পথে ছিনতাইকারীরা চলন্ত রিকশা থেকে সুনিতার ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান দেওয়ায় রিকশা থেকে পড়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পান। এরপর তাঁর মৃত্যু হয়।

জবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী পারিসা আক্তার দুঃসাহসের সঙ্গে এক ছিনতাইকারীকে পাকড়াও করেছেন, আরেক ছিনতাইকারীকে কৌশলে ডেকে এনে পুলিশে সোপর্দ করেছেন। থিসিসের কাজে ২৩ জুলাই রাজধানীর সদরঘাট থেকে মিরপুর চিড়িয়াখানা গিয়েছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী। কাজ শেষে সেখান থেকে একটি বাসে করে যাচ্ছিলেন সদরঘাট। বাসে কথা বলার সময় কারওয়ান বাজারের যানজটে হ্যাঁচকা টানে মোবাইল নিয়ে লাপাত্তা এক ছিনতাইকারী। মুহূর্তের মধ্যে বাস থেকে নেমে ওই ছাত্রী ছিনতাইকারীকে ধাওয়া করেন। কিন্তু ভিড়ভাট্টায় ধরতে পারেননি। মুঠোফোনে থাকা ভার্সিটির কোর্সের গবেষণা প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হারিয়ে কারওয়ান বাজারের মূল সড়কের পাশে ইত্তেফাক-এর গলিতে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল ছাত্রীটি। ঠিক তখনই সামনে দিয়ে অন্য এক ছিনতাইকারী আরেক নারীর ব্যাগ ছিনতাই করে পালাচ্ছিল। ছাত্রীটি ছিনতাইকারীকে জাপটে ধরে মারপিট করেন। তারপর দুজনকেই পুলিশে সোপর্দ করা হয়। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ওই ছাত্রী ছিনতাইকারীর পকেট তল্লাশি করে একটি মুঠোফোন পান। তবে সেটি তাঁর নয়। পরে কৌশলে ছিনতাইকারীকে দিয়ে ফোন করে তাঁর সহযোগীকে ডেকে এনে তাঁকেও পেটানো হয়। তবে তাঁর কাছেও ছিল না ছাত্রীর মুঠোফোন। এরপর ছিনতাইকারী তুষার ও তাঁর সহযোগী রাসেলকে তেজগাঁও থানা-পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হয়।

মুঠোফোন ছিনতাই হওয়ায় পুলিশের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন পারিসা আক্তার। পারিসা বলেন, ‘মোবাইলে আমার থিসিসের অনেক ডকুমেন্ট ছিল। মোবাইল হারিয়ে যাওয়ায় গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। নতুন করে আবার থিসিসের কাজ করা খুব কষ্টকর। একধরনের মানসিক বিষণ্নতার মধ্যে রয়েছি।’

এক নারী শিক্ষার্থী ছিনতাইকারীকে ধরেছেন, এক পুরুষ শিক্ষার্থী (আহমেদ রনি) একাই রেলের মতো এত বড় প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। এগুলো ভালো লক্ষণ কি? আমরা পারিসা ও আহমেদ রনির সাহসিকতার উত্তর চাই। সবার দ্বারা কি এভাবে দৌড়ে, জাপটে ছিনতাইকারীদের ধরা সম্ভব? একজন মানুষকে তার নিজের মোবাইলে কথা বলার সময় কেন সতর্ক থাকতে হবে? কেউ সে মুঠোফোন ছিনতাই করতে পারে, এই আশঙ্কায় কি সে রাস্তায় মুঠোফোন ব্যবহার করা বন্ধ করে দেবে?

ছিনতাইকারীকে পুলিশ ধরতে পারে না, এটা কি কেউ বিশ্বাস করবে? পুলিশের কি জানা নেই কোথায় ছিনতাই হয়, আর কারা করে? ছিনতাইকারীরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে তাদের অসদুদ্দেশ্য চরিতার্থ করছে। হেঁটে, রিকশায়, বাসে বা বাইকে যেভাবেই হোক, ছিনতাইকারীদের নাগালের বাইরে যাওয়া কঠিন। গুলি করে বা ছুরি মেরে, কখনো অস্ত্রের ভয় দেখিয়েই সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়া হয়। মোটরসাইকেল বা গাড়িতে করে এসে রিকশাযাত্রীদের ব্যাগ ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁচকা টানে পড়ে গিয়ে মৃত্যু ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বহুবার।

রাজধানীর সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, মিরপুর, এয়ারপোর্ট, আবদুল্লাহপুর, আজমপুর, টঙ্গী, কলেজগেট, গাজীপুরে এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। এসব স্পটে নিয়মিত ৮-১০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। পুলিশ ছাড়া এটা জানে না এমন ঢাকাবাসী কেউ নেই। আসলে পুলিশ ভালোভাবেই জানে কারা ছিনতাইকারী, বাকিটা ইতিহাস! আমরা মনে করি, এসব এলাকায় এখনই পর্যাপ্ত গোয়েন্দা নজরদারি নেওয়া হোক।