আগামীর বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চাই, একজন তরুণের চোখে

সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ফুল নিয়ে অপেক্ষায় বিভিন্ন সংগঠনফাইল ছবি

সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও অফুরন্ত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। আমাদের অতীত মহান ছিল। একটা সময় আমরা ছিলাম পৃথিবীর ষষ্ঠ সমৃদ্ধিশালী দেশ। আমাদের ভবিষ্যৎও হবে মহান, দেশ নিয়ে আমাদের আছে স্পষ্ট মনছবি—ভালো মানুষ, ভালো দেশ, স্বর্গভূমি বাংলাদেশ। কেমন বাংলাদেশ চাই? দেশ নিয়ে তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা—

  • বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে বিশ্বের সেরা ১০ সমৃদ্ধ জাতির একটিতে। গবেষণা, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য ও ক্রীড়া—সব ক্ষেত্রেই প্রথম সারিতে দেশ।

  • শিল্পায়ন শুধু ঢাকা বা চট্টগ্রামকেন্দ্রিক নেই। দেশজুড়েই একের পর এক গড়ে উঠেছে সুপরিকল্পিত, সবুজে ঘেরা আধুনিক শিল্পশহর। যেখানে নির্মিত হচ্ছে বিশাল বিশাল ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রো, যানবাহন, রেল, হেলিকপ্টার, ড্রোন, বিমান, জাহাজসহ প্রয়োজনীয় সব পণ্য।

  • প্রযুক্তিতে ঈর্ষণীয় উন্নতি হলেও তা ব্যবহৃত হচ্ছে শুধু মানুষের কল্যাণে। ডিজিটাল ডিভাইস ও সোশ্যাল মিডিয়ার কুফল সম্পর্কে সচেতন হয়েছে তরুণসমাজ। ফলে তারা এসব প্রযুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার বদলে এগুলোকে রাখতে পারছে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে।

  • দেশের শিক্ষাব্যবস্থা স্রেফ জিপিএ-৫ বা মার্কসভিত্তিক নেই, পরিণত হয়েছে দক্ষতামুখী শিক্ষাব্যবস্থায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কেবল জ্ঞান বিতরণই হচ্ছে না, জ্ঞানও সৃষ্টি হচ্ছে। গবেষণার অপার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ফলে উন্নত দেশ থেকেও শিক্ষার্থীরা দলে দলে বাংলাদেশে আসছেন উচ্চতর ডিগ্রি নিতে।

  • দেশে মেধাবিকাশের সমান সুযোগ পাচ্ছে সবাই। ফলে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে দেশের মানুষ। বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে উদ্যোক্তার দেশে, উন্নীত হয়েছে বিশ্ববাণিজ্যের শীর্ষে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে উদ্যোক্তারা ছড়িয়ে পড়েছেন সারা বিশ্বে।

  • দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অগ্রগতি বিশ্বের বুকে স্থাপন করেছে অনন্য নজির। ফিরে এসেছে নিরাপত্তা সহানুভূতি সহমর্মিতার হারানো সময়। শিশু, নারীসহ সব মানুষ দিনের যেকোনো সময় দেশের যেকোনো স্থানে নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছে।

  • চিকিৎসাব্যবস্থায় প্রভূত উন্নতি হয়েছে, কমেছে চিকিৎসার ব্যয়। ফলে বাংলাদেশের মানুষ দেশেই চিকিৎসা নিচ্ছে শুধু নয়, বাইরের দেশ থেকেও মানুষ বাংলাদেশে আসছেন উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজনে।

  • দেশে কোনো লোডশেডিং নেই। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থায় আধুনিকায়নের ফলে এগুলোর সরবরাহ থাকছে নিরবচ্ছিন্ন। দ্রুতগতির ইন্টারনেটে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ।

  • কাজকর্ম লেনদেন কেনাকাটা সবই হচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যমে। লেনদেন হয়েছে সহজ ও নিরাপদ, দেশ পরিণত হয়েছে ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’-এ।

  • কলকারখানা ও যানবাহনে দূষণরোধী প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে দেশের পানি, বায়ু ও মাটি হয়েছে দূষণমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত। পাশাপাশি খাবারে ভেজাল ও ক্ষতিকর কেমিক্যাল না থাকায় জনস্বাস্থ্য হয়েছে উন্নত।

  • পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন ঘটেছে। প্রবল বৃষ্টিতেও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে কমেছে অল্পতেই বন্যাকবলিত হওয়ার প্রবণতা।

  • অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি গুটিকয় মানুষে সীমাবদ্ধ নেই। সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থায় এসেছে সাম্য, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে সবার। ফলে মানুষের জীবনমানে ঘটেছে অভাবনীয় উন্নতি; দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত হয়েছে দেশ।

  • সম্প্রসারিত হয়েছে মেট্রো ও আন্তজেলা রেল যোগাযোগ। রেল চলাচল ব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছে উচ্চগতিসম্পন্ন বুলেট ট্রেন।

  • সুপরিকল্পিত ফ্লাইওভার ও এক্সপ্রেসওয়ের কল্যাণে এবং ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় প্রযুক্তির বহুল ব্যবহারে সড়ক পরিবহনব্যবস্থায়ও এসেছে গতি; ঘটছে না সড়ক দুর্ঘটনা। যানজটমুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। ফলে ভিআইপি চলাচলের জন্য সাধারণ যান চলাচল বন্ধ করার প্রয়োজন হচ্ছে না। সাধারণ মানুষ সহজেই ক্লাস, অফিস ও কেনাকাটা করতে পারছেন এক শহর থেকে আরেক শহরে।

  • খনন ও সংস্কারের ফলে নদী–নালা, খাল–বিলের নাব্যতা বাড়ায় আবারও চালু হয়েছে বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা জলযান চলাচল।

  • নির্বিঘ্ন ও দ্রুতগতিসম্পন্ন পরিবহনব্যবস্থার ফলে পণ্য পরিবহনে এসেছে গতি। ফলে সাধ্যের মধ্যে এসেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। নতুন বাংলাদেশে দরকার একটা ভালো সিস্টেম। ভালো দেশ মানে ভালো সিস্টেম। যে দেশের সিস্টেম যত ভালো, সে দেশ তত ভালো ও উন্নত।

  • সামান্য একটি ট্রেড লাইসেন্স পেতে দৌড়াতে হয় এই অফিস থেকে ওই অফিস, এই ডেস্ক থেকে ওই ডেস্কে। উপরন্তু আইনগত ফির সঙ্গে মেটাতে হয় ফির বহুগুণ ‘স্পিড মানি’। এটা মোটেই ভালো দেশের পরিচায়ক নয়। ভালো দেশে থাকবে সুন্দর একটা সিস্টেম, যার মাধ্যমে মানুষ পাবেন ওয়ান-স্টপ সার্ভিস।

  • ধরুন, আপনি ট্রেড লাইসেন্সের জন্য অনলাইনে আবেদনের পর ফি পরিশোধ করে দিলেন। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ট্রেড লাইসেন্স রেডি হয়ে পৌঁছে গেল আপনার ঠিকানায়—আগামী দিনের বাংলাদেশে আমরা চাই এমন সুন্দর একটা সিস্টেম, যেখানে পূর্ণোদ্যমে চলবে অফিস, আদালত, ব্যাংক, বাজার, থাকবে না ফাইল জট। মানুষ পাবে যথাযথ সেবা।

  • ‘এত মানুষের ভার কীভাবে বইবে দেশ!’ আমরা বলি, সন্তান চারের কম নয়, এর বেশি যত হয়! ভয় নেই, এত মানুষের ভারে দেশ নুয়ে পড়বে না। দেশের যে বিপুল উৎপাদনক্ষমতা, তা দিয়ে সম্ভব অন্তত ৫০ কোটি মানুষের খাদ্যসংস্থান। আসলে দেশে প্রয়োজন জনসংখ্যার একটা বিস্ফোরণ। কারণ, একটি শিশু কেবল মুখ নিয়েই জন্মগ্রহণ করে না, মস্তিষ্ক নিয়েও জন্মগ্রহণ করে। আর মস্তিষ্ক দিয়েই মানুষ বদলে দিয়েছে সভ্যতার চেহারা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে অগ্রগতি, তা এই মস্তিষ্ক দিয়েই।

    তা ছাড়া ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখব, অতীতে যেসব অঞ্চলে সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে, তার প্রতিটিতেই ঘটেছিল জনসংখ্যার বিস্ফোরণ। কারণ, যখন একটি অঞ্চলে জনসংখ্যা অনেক বেড়ে যায়, তখন ঘটে একটা উলম্ফন, কোনো কাঁটাতারের বেড়াই পারে না তাদের আটকে রাখতে।

    দ্য ইকোনমিস্টের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, উন্নয়নের জন্য জনসংখ্যাই হলো নিয়তি। আর জনমিতি–বিশেষজ্ঞরা বলেন, যে অঞ্চলের জনসংখ্যা যত বড় হবে, নেক্সট গ্রেট পাওয়ারের উদ্ভব হবে সেখান থেকে।

  • নদীর মোহনা ও বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা বিভিন্ন চর ও দ্বীপ দেখাচ্ছে নতুন স্বপ্নের হাতছানি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ সাগরে তলিয়ে যাবে, এমন আশঙ্কার কথা বলা হলেও বাস্তবে বঙ্গোপসাগরের বুকে হাতছানি দিচ্ছে আরেক বাংলাদেশ।

  • কক্সবাজার থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে সাগরের মাঝখানে জেগে উঠছে সুন্দরবনের আদলে নতুন ভূমি। অথই নীল জলরাশির মধ্যে জেগে উঠছে মাইলের পর মাইল ভূখণ্ড। যেখানে সম্ভব সুন্দরবনের মতো ১০টি সুন্দরবন সৃষ্টি।

  • বাংলাদেশের তরুণেরা এখন এমন একটা বাংলাদেশ চান, যেখানে পৃথিবীজুড়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণা, শিক্ষা, শিল্প, ক্রীড়া, চিকিৎসা প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা দেব সেবা ও নেতৃত্ব।

  • বিশ্বের সব কটি দেশের সঙ্গে সুন্দর ও সহযোগিতামূলক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে। প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের জটিল কাজকর্মের ব্যাপারে বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবে। সেবা ও মানবিকতার বাণী পৌঁছে দিতে আমরা ছড়িয়ে পড়ব বিশ্বময়।

  • অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের হাতছানিতে দলে দলে বাংলাদেশে আসবেন ভাগ্যান্বেষী মানুষেরা। প্রবাসীরা দেশে ফিরে আসবেন; হাত লাগাবেন দেশ গড়ার কাজে। বাংলাদেশ পরিণত হবে ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে বহমান আনন্দ, উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ এক মানবিক মহাসমাজে।

  • বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী মানুষ সংখ্যায় পুরো জনগোষ্ঠীর ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ৪ জনে ১ জনই তরুণ। তাঁদের একটি বড় অংশ আবার Zoomers, Generation-Z বা জেন-জির সদস্য। অতএব তরুণদের ওপরই নির্ভর করছে দেশের ভালো–মন্দ।

  • কাজেই নতুন বাংলাদেশে আমরা চাই মাদকমুক্ত তরুণসমাজ, যারা নিজেদের পরিণত করবে মেধাবী ও দক্ষ মানবিক জনসম্পদে। চাকরি নয়, তরুণদের লক্ষ্য হবে পেশা। ফলে থাকবে না বেকারত্ব। হতাশা, বিষণ্নতা ও আত্মহত্যার প্রবণতা হবে দূর।

  • দেশটাকে ভালো ভাবি, বড় ভাবি ও ভালোবাসি। স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে নিজের কাজ করি সবচেয়ে ভালোভাবে। আমাদের আজকের ভাবনাই মাস-বছর পেরিয়ে পরিণত হবে বাস্তবতায়—ভালো মানুষ, ভালো দেশ, স্বর্গভূমি বাংলাদেশ।

*লেখক: মাহমুদুল হাসান, স্বেচ্ছাসেবী কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]