এক দিন ট্রেনে

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ১০ দিন; নির্বাচন আর শীতকালীন ছুটি। এবার বাড়ি যাচ্ছি না। দুই মাস আগে বাড়ি থেকে এসেছি, ঈদের ছুটিতে আবার যাব। বন্ধু সাব্বির জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে পড়ে, দ্বিতীয় সেমিস্টার শেষ। কয়েক দিনের ছুটিতে টাঙ্গাইল নন্দবালায় গ্রামের বাড়িতে এসেছে। অনুরোধ করেছে ওর বাড়িতে যেতে। সঙ্গে বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব (রক্তি, আতিয়া...) ওরাও। প্রথম দিকে যেতে রাজি ছিলাম না, যেহেতু কয়েক মাস আগেও গিয়েছিলাম। এদিকে ক্যাম্পাসও ফাঁকা হচ্ছে, রুমেও বোরিং লাগছিল। একপর্যায়ে রাজি হলাম, ২৮ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় ক্লাস শেষে বিকেলের ট্রেনে যাব।

বিকেল ৪টায় ঢাকাগামী পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেন। অনলাইনে সিট আগেই বিক্রি শেষ। যেহেতু টাঙ্গাইল যাচ্ছি না, তাই টিকিট সংগ্রহ করা হয়নি সময়মতো। বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে রাজশাহী স্টেশনে এলাম। ট্রেন ছাড়তে ১০ মিনিট বাকি। স্ট্যান্ডিং টিকিট সংগ্রহ করতে ১ নম্বর কাউন্টারের নাতিদীর্ঘ লাইনের শেষে দাঁড়ালাম। এদিকে একজন লোক লাইনের মধ্যে জায়গা নিতে চাইলেন। পেছনের লোকজন চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, ‘পিছনে দাঁড়ান, পিছনে দাঁড়ান, আমরাও টিকিট কাটমু।’ বেচারা, পেছনে না গিয়ে পারলেন না।

তিন মিনিট আগে টিকিট হাতে পেলাম। রাজশাহী-বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব স্টেশন পর্যন্ত; মূল্য ২৩৫ টাকা। যদিও আমার গন্তব্য ছিল ঘারিন্দা স্টেশন, টাঙ্গাইল। কাউন্টার মাস্টার ৫ টাকা বেশি নিলেন। অন্য যাত্রীদের থেকেও ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি নিলেন খুচরা নেই এই কথা বলে। কেউ কোনো প্রতিবাদ করলেন না। কেননা ট্রেন ছাড়তে আর বেশি সময় নেই।

কাঁধে ছোট ব্যাগ, গুটি গুটি পায়ে দৌড়াতে লাগলাম। আমার মতো অন্যরাও। তৃতীয় বগিতে উঠতে চাইলাম, পুলিশ ফিরিয়ে দিল, ‘ওই শেষের বগিতে যান, এগুলো এসি।’

উঠলাম ‘জ’ বগিতে। এমনিতেই লোকে লোকারণ্য, তাতে শেষের দিকে উঠি। কেউ কেউ বললেন, ‘ভাই, ভেতরে যান গা।’ ‘ভিতরে জায়গা থাকতে আপনারা এখানে কেন?’

‘আমরা চাটমোহন স্টেশনে নামমু, তাই ভিতরে যাই নাই।’

আমিও কষ্ট করে ঠেলতে ঠেলতে যাচ্ছি আর মনে মনে ভাবছি, এখানে টয়লেটের সুগন্ধি ফ্রিতে উপভোগ না করি। এত গাদাগাদি লোক আগে কখনো ট্রেনে দেখিনি। শেষ থেকে দ্বিতীয় সারি চেয়ারের পাশে শক্ত করে দাঁড়াই।

ট্রেন চলতে লাগল। আমার মতো অনেকেই ভেতরে আছেন, কারও মাথায় বস্তা, হাতে-কাঁধে দু-তিনটি ব্যাগ, ভারী লাগেজ, ছোট্ট বাচ্চা, কেউ আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ঝাড়ু, বেগুন, মুলা, কেউবা ভারী দেহ নিয়ে একটু আরামের জায়গা দখলের আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। সব স্থানে গিয়ে বলছে, ‘ভাই/ আপা একটু চেপে দাঁড়ান, সামনে যাব।’ যথেষ্ট জায়গা নেই, চেঁচামেচিও করছে, আবার যেতেও জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে, অন্যের গায়ে পড়ে হলেও।

শক্ত করে দাঁড়িয়েছি ঠিকই, শক্তভাবে থাকতে পারছি না। সাইড দিতেই হচ্ছে। এক মহিলা বলে উঠলেন, ‘আপনাদের জ্বালায় বইসা থাইকাও শান্তি পাইতাছি না, উপরে আইসা পড়েন ক্যা; এমনিতেই ছোট পোলাপান কোলে?’ ‘আপনাদের গায়ে পড়ার ইচ্ছা নেই, পরিস্থিতির স্বীকার, কিচ্ছু করার নেই।’ এদিকে একটি ছয় থেকে সাত বছরের একটি ছেলে জানালার পর্দার পিন খুলছে দেখে আমার পাশের লোকটি ধমকিয়ে উঠলেন, ‘এই ছেলে পিন খুলছ কেন? বাচ্চার মা-বাবা কি দেখছে না বাচ্চা কী করছে?’ প্রত্যুত্তরে ভদ্রমহিলা জবাব দিলেন, ‘দেখলে তো না করতাম, ইচ্ছা করে তো আর খুলতে বলিনি।’

একটু পরেই টিটিই এলেন টিকিট চেক করতে। পাশের সেই নারী, যে আমাকে গায়ে পড়তে নিষেধ করলেন, তাঁরা তিনজন; টিকিট দুটি, যাবে কমলাপুর। শুরু হলো টিটিই আর তাঁর দর-কষাকষি।

একপর্যায়ে চার শ টাকা নিয়েই ছাড়লেন। ডান পাশের সারির শেষে দুজন নারী দাঁড়িয়ে; টিকিট আগে থেকে নেননি। যাবেন বিমানবন্দর, অথচ টাঙ্গাইলের কথা বলে তিন শ টাকা ধরিয়ে দিলেন। মেয়ে মানুষ বলে হয়তো অল্পতেই চলে গেলেন।

দুই স্টেশন অতিক্রম করে ট্রেন আবদুলপুর স্টেশনে দুই মিনিটের ব্রেক দিল। হুমড়ি খেয়ে কিছু মানুষ নামলেন, উঠলেন বেশি। ভিড় ঠেলে এক আপু এলেন। বয়স ২৫ কি ২৬, এর বেশি হবে না। বেশ সুশ্রী; সঙ্গে দুটি ব্যাগ; যাবেন উল্লাপাড়া। আমার কাছে সাইড চাইলেন, ‘ভাইয়া, একটু যেতে দেন।’ যথারীতি উপায় নেই, তাও দিতেই হলো। একটু পেছনে এলাম, তিনি সামনে আমার স্থান দখলে নিলেন। এ সময় একে-অপরের সঙ্গে এমনভাবে ঘষা লাগল যদি রাস্তাঘাটে কোথাও এমনটি হতো, নিশ্চিত আমার রক্ষা ছিল না।

একটু পরপর একজন ট্রেনে ‘এই নাশতা, গরম-গরম নাশতা’, বলছে আর যাত্রীদের মুখের সামনে ধরছে।

মনে হচ্ছে না কেউ কিনছে। একই প্যাকেট বারবার দেখলাম। একজন পানি, পানি বলে হাঁকছে। আবার দুজন আসে চা-কফি নিয়ে পালাক্রমে। চা খেতে চাইলাম, ১৫ টাকা কাপ; দাম শুনে আগ্রহ বিসর্জন দিলাম। অন্য হকার তো আছেই। দরজার কাছে একজন নারী চেঁচাচ্ছেন, হকারদের কেউ একজন তাঁর পায়ে পাড়া দিয়েছে। নিজেও কত পাড়া খেয়েছি, হিসাব নেই।

উল্লাপাড়া স্টেশনে ট্রেন কিছুটা খালি হলো। আগের মতো ভিড় নেই। সেখান থেকে সরে দাঁড়ালাম সেই মেয়ে দুটির পাশে। একটু নিরাপদ; কেউ সাইড চাইবে না; একদম সিটের পেছনে। এরই মধ্যে সেই ছেলেটির (যে পর্দার পিন খোলায় বকা খেল) সঙ্গে মেয়ে দুটির বেশ ভাব হয়েছে। মনে হচ্ছিল তারা বহুদিনের পরিচিত। আমিও যোগ দিলাম ছেলেটির সঙ্গে। চোখের ভঙ্গি দিয়ে শুরু করলাম। ছেলেটিও সায় দিল। ওর বোন আড় চোখে দেখছে আর মিষ্টি মিষ্টি হাসছে। একটু পর পরিচিত হলাম। ওর নাম ফুয়াদ। কিন্ডারগার্টেনে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। ঢাকার সাইনবোর্ডে বাসা। রাজশাহীতে এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে আসছিল। কথাবার্তায় বোঝা গেল মধ্য-অভিজাত পরিবারে জন্ম।

মেয়ে দুটি একটু পরপর দাঁড়িয়ে থাকে আবার অদৃশ্য হয়। দেহ তেমন ভারী না হওয়ায় অনায়াসে সিটের পেছনের ফ্লোরে বসতে পারে। কুটকুট করে কথা বলে, হাসাহাসি করে, গেম খেলে, মাঝেমধ্যে আমার হাঁটুতে টাচ লাগে। বিষয়টি বেশ উপভোগ্য। যদিও কারও মুখ দেখা হয়নি। একজন মাস্ক পরা আরেকজন কালো বোরকায় আবৃত। কথা বলতে চেয়েও বললাম না, দরকারই নেই, তা-ই। মেয়েরা দাঁড়াল স্বস্তির নিশ্বাস পেতে।

দুজন হিজড়া এলেন, ‘ওই মাল টাকা দে।’ দিলাম ১০ টাকা, ওদের সঙ্গে না লাগাই ভালো। মেয়েদের কাছেও চাইল, হিজড়া অন্য দিকে মুখ করতেই ওরা আবার মিলিয়ে গেল সিটের নিচে। আমাকে বলল, ‘তোর পাশের ছেমরিরা কনে গেল।’ উত্তর দিলাম না, চলে গেল। ওদের দেখে অনেকেই ঘুমের ভান করছে। রক্ষা নেই, কাছে গিয়েই হাত চাপড়াতে লাগল। ‘ওই জামাই, টাকা দে, দে নারে দে, দে। তোরা না দিলে চলমু কেমনে...।’

বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমে ১০ মিনিটের ব্রেক। হকার হরেক রকম খাদ্যপণ্যের হাঁক ছাড়ছেন। যদিও সারা পথে এত হকার একসঙ্গে আসেননি। ‘এই মিষ্টি পেয়ারা.. মিষ্টি পেয়ারা.. মিষ্টি আমড়া খান’, ‘চানাচুর..ঝাল চানাচুর’, ‘ছোলা..ছোলা এই শসা... শসা..গাজর’, ‘এই ৪ পেঁয়াজু-শিঙাড়া ১০ টাকা...’, ‘এই যে গেল পপকন..পপকন’, ‘এই গরম-গরম ডিম-খিচুড়ি খালি ৪০, খালি ৪০।’ আরও কত হাঁকডাক। বেশ ক্ষুধার ভাব। প্রথমে শিঙাড়া-পেঁয়াজু নিলাম। ছেলেটিকে একটি দিলাম। খুশি হয়ে হাতে নিল; ওর মা নিষেধ করল, ‘ফেরত দাও, তোমার চিপস খাও।’ ফেরত দিতে না চাইলেও দিল। বড়দের কথার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই বোঝা গেল।

এবার গাজর আর পপকন নিলাম। ছেলেটি তাকিয়ে রইল, গাজর খাওয়া দেখল। আমিও আগবাড়িয়ে দিলাম না। এমনিতেই বাসে-ট্রেনে অপরিচিত লোকের কাছে কিছু না নেওয়াই ভালো। মা হয়তো সেই শিক্ষাই দিচ্ছেন। মন চাইল মেয়েদের পপকন দিই, মানসিক দ্বিধায় আছি। যদি রিজেক্ট করে, এই ভেবে দিলাম না। ওরাও ঝাল চানাচুর কিনল। জিজ্ঞাসা করল, ‘ভাইয়া, এটা কোন স্টেশন?’ উত্তর দিলাম।

দুজনেই রাজশাহী পলিটেকনিকে পড়ে। মাস্কওয়ালির বাসা পঞ্চগড়, যাবে ভাই-ভাবির কাছে। আরেকজনের বাসা জয়দেবপুর।

এক ভাই গরম খিচুড়ি ভেবে হাতে নিলেন কিন্তু ঠান্ডা। ফেরত দিতে চাইলে হকার নিলেন না। ‘ট্যাহা না দিলেন মামা, ফেরত নিমু না।’ আমার ধারণা, বেচাকেনা তেমন হয়নি। তাই জোর করেই বিক্রি করছে। কয়েক মিনিট কথা-কাটাকাটি চলল। বিরক্ত হয়ে ভাইটি টাকা দিয়ে দিলেন।

টাঙ্গাইল স্টেশনে নামলাম। কথায় আছে ‘চোরের মন পুলিশ পুলিশ।’ যদি টিকিট চেক করে তাহলে ফেঁসে যাব। জরিমানাও করতে পারে; কিচ্ছু করার থাকবে না। যেহেতু সেতুর পূর্ব পর্যন্ত টিকিট নিয়েছি, এলাম এক স্টেশন বেশি। চুপচাপ বের হলাম, মিচি বিড়ালের মতো। কেউ কিছু বলল না। বটগাছের নিচে দাঁড়ালাম। অবশেষে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

  • লেখক: সবুজ আহমেদ, সমাজবিজ্ঞান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়