পারিবারিক পরিবেশ শিশুর সুন্দরতম মানসিক বিকাশের সহায়ক

ফাইল ছবি

ব্যক্তিগত ব্যাপারটা বোধ হয় ছোট–বড় সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বড়দের যেমন মতামতের দাম আছে তেমনি ছোটদের মতামতকেও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ছোটদের সব ধরনের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে, এমনটা নয়। তবে তাদের মনের ওপর যেন চাপ না পড়ে, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।

আমার নিজের কথাই বলি। আমি যখন ছোট ছিলাম, অনেক কিছু পারতাম। যেমন ছড়া, কবিতা, গান আবার নাক বাঁকিয়ে সার্কাস দেখানো, এসব আরকি। আমার মনে হয়, ছেলেবেলায় সব বাচ্চাই এসব কম–বেশি পারে এবং বাসায় অতিথি এলে মা–বাবা ও ভাইবোনের অনুরোধে তাঁদের সামনে সেসব অযৌক্তিক পারফরম্যান্স হাসিমুখে করে দেখাতে হয়। হয়তো আমার মতো আপনারাও করেছেন। এতে আমরা ছোটরা বিরক্ত হলেও মা-বাবা খুব খুশি হতেন।

ছোটবেলায় আসলে বাচ্চাদের চাওয়া অনেকটা মূল্যহীন মনে হয়। যেমন ধরুন রিকশায় চড়া। হাজার চাওয়া ও শখ থাকলেও, বড়দের কোলেই বসতে হতো, সিটে বসার সৌভাগ্য আর হতো না। অনেক কিছুই হয়তো আমাদের শিশু মন চাইত, কিন্তু সবকিছু যদি অভিভাবকেরা পাত্তা দেন, তাহলে বোধ হয় শিশুর জন্য তা মঙ্গলজনক হয় না।

আমি কথাগুলো যে কারণে বলছি তা হলো, আজকাল কিছু মা–বাবাকে দেখছি সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের ছোট বাচ্চাদের দিয়ে নানা কিছু করান। মানে প্রতিদিন তারা কী করছে, কী খাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে, কীভাবে ঘুমাচ্ছে, এসব প্রাত্যহিক কাজকর্ম আরকি!

আমার কথা হলো, এসব মা–বাবা কি সন্তানদের অনুমতি নিয়ে তাদের দিয়ে এসব করাচ্ছেন? হয়তো বলবেন, শিশুর আবার মতামত কী? তাকে সারা দেশের লোক দেখছে, চিনছে, এটাই তো অনেক।

কিন্তু না, শিশুর অনুমতির প্রয়োজন আছে। এখন হয়তো সে বুঝতে পারছে না, কিন্তু একটা সময় সে বড় হবে, আলাদা ব্যক্তিত্ব তৈরি হবে, তখন মা–বাবাকে প্রশ্ন করতেই পারে, কেন তোমরা আমাকে দিয়ে এসব করিয়েছ? কেন আমার রোজকার বেড়ে ওঠার গল্প অচেনা–অজানা মানুষের সঙ্গে শেয়ার করেছ? আমি তো এমনটা চাইনি! শিশুরাও কিন্তু বেশ ইন্ট্রোভার্ট হয়। গাম্ভীর্য নিয়ে থাকতে পছন্দ করে।

এই যে মা–বাবারা পারিবারিক ভিডিও বানিয়ে বাণিজ্যিকভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, এতে তাঁরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন বলেই এমন কাজ করছেন। কিন্তু একটা শিশুর গোপনীয়তা যেমন এতে রক্ষা হচ্ছে না, তেমনি এটা অন্য শিশুর জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

যদি বলেন কী করে? তাহলে শুনুন...

আপনি হয়তো আপনার বাচ্চাকে সেভাবে মোবাইল ফোন দেন না বা দিন–রাত কম্পিউটার–টিভিও দেখতে দেন না। একটা স্বাভাবিক রুটিনের ভেতর দিয়ে তাদের মানুষ করছেন। কিন্তু যখন আপনার বাচ্চা দেখবে তারই কোনো বন্ধু বা চেনাজানা অন্য কোনো বাচ্চা নিয়মিত ফেসবুকে তার প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড শেয়ার করছে এবং সেই ভিডিও লাখো মানুষ দেখছে, তখন তারও মনে হবে আমিও এমন কিছু করব, যাতে আমাকেও সারা দেশের মানুষ চেনে ও ভালো বলে। বন্ধুদের যখন এত জনপ্রিয় হতে দেখবে তখন তারও এমন হতে ইচ্ছা করবে, এটাই স্বাভাবিক। আপনি শত বারণ করলেও সে হয়তো সেটা শুনবে না। যেখানে মিডিয়া আমাদের বড়দের ওপরেই প্রভাব ফেলে, সেখানে ছোটদের কথা তো বলাই বাহুল্য।

হ্যাঁ, যাঁরা এসব করেন তাঁরা বলতেই পারেন আমি আমার বাচ্চাকে দিয়ে যা খুশি তাই করাব, সারা দুনিয়াকে দেখাব আমাদের নিত্যদিনের কাজকর্ম, তাতে আপনাদের কী?

লেখক
ছবি: সংগৃহীত

না, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে সমাজের প্রতি আমাদের সবারই কিছু দায়বদ্ধতা থাকে। সেটা বিবেচনা করেই আমরা যা খুশি তা করতে পারি না। নিজের ক্ষতি করলেও অন্যের জন্য ভালো নয়, এমন কাজ করা উচিত নয়।

শিশুদের অনেক কিছু করার আছে। এই যেমন ধরুন গান, কবিতা, গল্প, ছড়া শেখা, ছবি আঁকা, নাচ শেখা, তায়কোয়ান্দো করা। এমনকি বাড়ির মুরব্বিদের কাছ থেকে নানা রকম গল্প শোনা।

গান শুনলে মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন নামে একপ্রকার হরমোন নিঃসৃত হয়, যা শিশুকে উদ্দীপনায় ভরিয়ে রাখে।

বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য বিভিন্ন ধরনের বই কিনে দিতে পারেন। এতে তাদের বুদ্ধিমত্তা বাড়বে।

সৃজনশীলতা বাড়াতে অন্য আরও অনেক উপায় আছে, এসব টিকটক ও ভিডিও বানানো ছাড়া। বাস্তবসম্মত গল্প বলুন তাদের। ঘরের কাজে ওদের সাহায্য নিন। যেন বড় হতে হতে ওরা সত্যিকার বাস্তবতাটা বুঝতে পারে।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

মনোবিজ্ঞানী জিন পাইগেট, তাঁর ‘সাইকোলজি অব দ্য চাইল্ড’ গ্রন্থে বলেছেন, মানুষের মন একটি শক্তিশালী একক। এটি সবার মধ্যে সমানভাবে থাকে। শিশু অবস্থায় মনোভাব প্রকাশ এক রকম আবার প্রাপ্ত বয়সে অন্য রকম।

এ ক্ষেত্রে পরিবারের অভিভাবকেরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু মূল্যায়ন করে থাকেন এবং পরিবারের বড়দের একটা প্রকট ভূমিকা থাকে শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে।

কাজেই আপনার শিশুকে অন্যদের কাছে খুব অনায়াসে সস্তা হতে না দিয়ে তাকে তার মতো করে বেড়ে উঠতে দিন।

পুষ্টিকর খাবার যেমন শরীরকে সুস্থ রাখে তেমনি উপযুক্ত পারিবারিক পরিবেশ ও শিশুর সুন্দরতম মানসিক বিকাশে সহায়তা করে।

প্রযুক্তিনির্ভরতা যত বাড়ছে, শিশুদের মেধার বিকাশ ততই কমছে। সারা দিন ভিডিও গেম, টিকটক, বিভিন্ন রকম বিষয় নিয়ে ব্লগ বানানোর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে আজকাল শিশুরা। এর সঙ্গে যদি আমরা অভিভাবক হয়ে তাল দিতে থাকি তাহলে তো কোমলমতি শিশুদের ভবিষ্যৎ অনেকটাই অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হবে।

কিছুদিন আগে ঢাকার একটা নামকরা স্কুলের অধ্যক্ষ বলেছেন, মোবাইল ফোনের কারণে দিনে দিনে ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় খারাপ করছে।

আমাদের একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা কিন্তু থেকেই যায়। সে নিজের বাচ্চা হোক কিংবা অন্যের। ব্যক্তিগত বিষয় খুব সতর্কতা অবলম্বন করেই সামনে আনতে হয়। আপনার পারিবারিক জীবন ফোকাস করে হয়তো টাকা আয় হচ্ছে, কিন্তু সামাজিকভাবে অন্যদের কাছে নিজেকে খুব সস্তা করে ফেলছেন। শুনতে খারাপ লাগলেও, এটাই সত্যি।

ঔপন্যাসিক জেমস বেদুইন বলেছেন, ‘বড়দের কথা শোনার ক্ষেত্রে শিশুরা খুব দক্ষ নয়, তবে বড়দের অনুসরণ করার ক্ষেত্রে তারা কখনো ব্যর্থ হয় না।’

একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন, একটা শিশুর অপরিণত ব্যক্তিত্বকে তার অজান্তেই বিলিয়ে দিচ্ছেন সমগ্র দুনিয়ার কাছে। ওকে ওর মতো করে বড় হতে দিন নিজস্বতা নিয়ে। সন্তানকে পাবলিক করার আগে তার অনুমতি নিন।

শিশু মনোবিজ্ঞানী হাইম গিনেট বলেছেন, ‘শিশুরা হচ্ছে ভেজা মাটির মতো। এর ওপর যা কিছু পতিত হয় তার ছাপ ফুটে ওঠে।’

তাই মা–বাবা হিসেবে সন্তানের ওপর এমন ছাপ ফেলুন, যা তার সারা জীবনের জন্য সম্মান ও সুখের পাথেয় হয়।

‘মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে

মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।

তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে

দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,

আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ’পরে

টগ্‌বগিয়ে তোমার পাশে পাশে।

রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে

রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।’

কল্পনার রঙিন জীবনের সন্ধান দেওয়ার পাশাপাশি সন্তানকে রবি ঠাকুরের কবিতার মতো এমন বীরপুরুষ করে গড়ে তুলুন। যেন জীবনের প্রতিটি ঘাত–প্রতিঘাতে সততার সঙ্গে মাথা উঁচু করে লড়াই করতে শেখে।

লেখক: রোজিনা রাখী, ফিচার লেখক