স্মৃতিপটে শীতকাল

তীব্র শীত উপেক্ষা করে মাঠ থেকে ধান তুলছেন এক কৃষক। আজ মঙ্গলবার সকালে নওগাঁ পৌরসভার জগৎসিংহপুর এলাকাছবি: প্রথম আলো

কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর। খেতের আইলে শিশিরভেজা ঘাস। আইল দিয়ে গাছিরা ছুটছেন খেজুরবাগানে। রস সংগ্রহ করবেন। প্রতিদিন ভোর হলেই তাঁদের ছুটে চলা। গায়ে গরম কাপড় জড়িয়ে কৃষকেরা বেরিয়ে পড়েন ফসলের মাঠে। শর্ষে, ধনিয়া, কলইসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ করতে ভোর থেকেই তাঁদের ছুটে চলা। কুয়াশার ফাঁকে সূর্যের উঁকি দিতে দিতে সকাল গড়িয়ে বেলা হয়ে যায়। তখনও পরিবেশ থাকে শীতল। জবুথবু। হেমন্তের পর শীতের অপরূপ সৌন্দর্য এসব দৃশ্য।

 শীতকাল গ্রাম বাংলার মানুষের আবেগ, অনুভুতি, আনন্দের জায়গা। শীতকাল গ্রামের অনুভূতি আলাদা। আমরা যারা গ্রামে বেড়ে উঠেছি, তখন দেখতাম শীতকালে আমাদের গ্রামবাংলার মানুষের মধ্যে পিঠাপুলি খাওয়া ও খেজুরের রস খাওয়ার  ধুম পড়ে যায়। কৃষকেরা নতুন ফসল ঘরে তুলে পরিবার–পরিজন আত্মীয়–স্বজন সঙ্গে নিয়ে ভোর থেকে পিঠা বানানো শুরু করে দিত। গ্রামের এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখি না বহুদিন।

 আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন প্রতি শীতে নানিবাড়ি যেতাম, কৃষকেরা দল বেঁধে ধান কাটার পর মাড়াই করে নতুন ধান ঘরে তোলার দৃশ্য সচক্ষে দেখতাম। সেই ধান ভাঙিয়ে আবার বাহারি রকমের মুখরোচক পিঠাপুলি বানানো হতো। নানির বাড়ি প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে হওয়ার ফলে নানা, নানি আমাদের জন্য ধান ভাঙিয়ে রেখে দিত। আমার পরীক্ষা শেষ হলে আমার খালা, খালু, খালাতো ভাই বোনেরা নানিবাড়িতে চলে যেতাম পিঠাপুলি খাওয়ার জন্য। স্মৃতির পাতায় রেখে আসা এমন সময়গুলো আর কখনো হয়তো ফিরে আসবে না, সেই সঙ্গে বেঁচে নেই নানা নানি।

 ভোর থেকে মা খালারা পিঠাপুলি বানাতে যেন ব্যস্ত সময় পার করতেন। আমি এবং আমার খালাতো ভাইবোনেরা তাঁদের সঙ্গে চোখ কচলাতে কচলাতে  উঠে যেতাম ঘুম থেকে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম উনুনের কাছে। ভোরবেলা কুয়াশায় জড়ানো গ্রামের প্রকৃতিতে যেনো কিছুই দেখা যায় না। আমরা ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে খড় বা গাছের ডালপালা দিয়ে আগুন ধরায় উঠোনের মাঝখানে সবাই একসাথে নানা রকম গল্প, কাহিনি, কেচ্ছা—এসব আলোচনা হতো আমাদের মধ্যে। আলোচনার মধ্যে আমাদের জন্য পিঠাপুলি তৈরি হয়ে যেতো।

তখন আমরা সবাই একসঙ্গে গ্রামের খেজুর পাতার তৈরি পাটিতে গ্রামের ভাষায় ধাপে (বারান্দায়) বসে খেতে বসতাম। নদীর তাজা মাছ, সঙ্গে আরও অনেক রকমের ভর্তা তো থাকতোই। সেই গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি, হারিকেন বা কুপি জ্বালিয়ে খেতে হতো। এখনো ওই স্মৃতিগুলো হাতড়ে বেড়াই, ফিরে যেতে চাই শৈশবের গ্রামবাংলায়। সময়ের সঙ্গে লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সেই সুবাদে আর যাওয়া হয় না, গ্রামগঞ্জে সচক্ষে দেখি না হিমেল হাওয়ার ভোরের শিশিরবিন্দু আর মাঠভরা ফসল। শীতের সকালে দলবেঁধে মনোমুগ্ধকর পাখিদের কিচিরমিচির আর মোরগের ডাক যেন আর বেজে ওঠে না কর্ণকুহরে। শীতের কুয়াশার চাদরে ঢাকা প্রকৃতির পূর্ব দিক থেকে লাল আভা নিয়ে উঁকি দেওয়া সূর্যের দৃশ্য যেন দেখি না বহুদিন।

 শীতের কারণে গ্রাম বাংলার মানুষের জীবন আর শহরাঞ্চলের মানুষের জীবন ভিন্নতর। শহরাঞ্চলের মানুষ শীতের সকাল মোরগের ডাক, পাখিদের কিচিরমিচির যেন তাদের কানে পৌছায় না। গ্রামের মানুষেরা আনন্দ–উল্লাসের সঙ্গে এই শীতকাল উদ্‌যাপন করে এবং তারাও যেন প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের অংশ হিসেবে বিবেচিত।

 *লেখক: মো. আজাদ হোসেন, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

**নাগরিক সংবাদ–এ লেখা, ভিডিও, ছবি, ভ্রমণকাহিনি, গল্প ও নানা আয়োজনের কথা পাঠান [email protected]