১৯৯২ সাল থেকে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর গুরুত্ব এবং মা ও শিশু উভয়ের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা ও সমর্থনের জন্য সারা বিশ্বে এ সপ্তাহটি পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশন (বিবিএফ), বাংলাদেশ পেরিনেটাল সোসাইটি (বিপিএস), বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরাম (বিএনএফ), বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ), বাংলাদেশ অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি (ওজিএসবি) এবং অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে সপ্তাহটি পালিত হয়ে আসছে। প্রতিবছরের মতো এবারও নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ১ থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালিত হচ্ছে। এ সপ্তাহটিতে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো এবং এর উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ব্রেস্টফিডিংকে অগ্রাধিকার দিন: টেকসই সহায়তা ব্যবস্থা তৈরি করুন’। বিশ্ব ব্রেস্টফিডিং সপ্তাহ বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১২০টির বেশি দেশে পালিত হয়। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ ও নাগরিক সমাজের অংশীদারদের দ্বারা সপ্তাহটি পালিত হয়ে আসছে।
এটা কেন গুরুত্বপূর্ণ
বুকের দুধ শিশুদের জন্য আদর্শ পুষ্টি এবং এতে অ্যান্টিবডি থাকে, যা রোগ প্রতিরোধ করে। এটি শিশুর প্রথম টিকা হিসেবে কাজ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শিশুর জীবনের প্রথম ছয় মাস শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়, এরপর দুই বছর বা তার বেশি সময় ধরে পরিপূরক খাবারের পাশাপাশি বুকের দুধ দিতে বলা হয়।
জন্মের প্রথম ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো
সামগ্রিকভাবে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য–সম্পর্কিত এসডিজি—টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ‘জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো’ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে আলোচিত। এটি একটি সাশ্রয়ী পদক্ষেপ, যা বাংলাদেশে মা এবং নবজাতক উভয়ের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।
কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস অ্যান্ড অ্যাসেসমেন্টে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, জন্মের প্রথম ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানোর হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, ২০০৪ সালে ২৬ শতাংশ থেকে ২০১৭-১৮ সালে তা ৬০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশে জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানোর হার এখনো মাত্র ৪০ শতাংশ, যেই হার বাড়ানোর জন্য গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
জন্মের প্রথম ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানোর উপকারিতা
জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো নবজাতক ও মা উভয়ের জন্যই উল্লেখযোগ্য সুবিধা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানোর ফলে নবজাতকের মৃত্যুহার ২২ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পায়। এটি নবজাতক শিশুর পুষ্টি ও বিকাশ উন্নত করে এবং মায়ের দুধ উৎপাদনে সহায়তা করে। প্রথম কয়েক দিন স্তন্য পান করানোর ফলে কোলোস্ট্রাম পাওয়া যায়, যা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ একটি দুধ, যা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, সুস্থতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো, শিশুদের শারীরিক ও মেধা বিকাশে সহায়তা করে।
বুকের দুধ খাওয়ানোর ফলে মা ও শিশু উভয়েরই দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যগত সুবিধা রয়েছে। এতে অক্সিটোসিন নামের হরমোন নিঃসৃত হয়, যা জরায়ু সংকোচনে সাহায্য করে এবং প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণের ঝুঁকি কমায়। যেসব মা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান তাঁদের ক্যানসারের ঝুঁকি কম থাকে। জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো বুকের দুধ উৎপাদনকে উদ্দীপিত করে এবং শিশুর জন্য নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করে।
বুকের দুধ খাওয়ানোর কেএমসি মাধ্যম
নবজাতকের ত্বকের সঙ্গে মায়ের ত্বকের সংযোগ (KMC), যা জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য সহায়ক। এটি শিশুর শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, হাইপোথার্মিয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে।
ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো
সেভ দ্য চিলড্রেনের মতে, শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো সঠিকভাবে চালু করলে প্রতিবছর ১০ লাখের বেশি শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব। ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের শুধু বুকের দুধ খাওয়াতে হবে, নির্ধারিত ওষুধ বা ভিটামিন ড্রপ ছাড়া অন্য কোনো তরল খাবার খাওয়ানো যাবে না। বিডিএইচএস (বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে) অনুযায়ী, ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর হার ৫৫ শতাংশ।
ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর সুবিধা
কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) তথ্য অনুসারে, শুধু বুকের দুধ শিশুদের ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, অপুষ্টি, হাঁপানি, স্থূলতা, ডায়াবেটিসসহ কিছু স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে। কানের ও পেটের সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি কমায়। সাধারণভাবে মা ও শিশুর মধ্যে দৃঢ় বন্ধন তৈরি হয়। মায়ের দুধ শিশুর পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য নিখুঁতভাবে তৈরি। বুকের দুধ খাওয়াতে বাড়তি কোনো ব্যয় নেই। প্রয়োজন শুধু সচেতনতা।
বুকের দুধ খাওয়ানোর ওপর প্রভাব ফেলার কারণগুলো
বুকের দুধ খাওয়ানোর অভ্যাসকে প্রভাবিত করে, এমন বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, বুকের দুধ খাওয়ানোর মনোভাব ও অনুশীলন বুকের দুধ খাওয়ানোর সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। পর্যাপ্ত তথ্য ও সহায়তার অভাব বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। কিছু প্রতিষ্ঠানে অপর্যাপ্ত মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা মায়েদের বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যাওয়া কঠিন করে তুলতে পারে। গবেষণায় দেখা যায়, বাসায় প্রসব এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রসব, জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানোর হার এবং ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর উচ্চ হারের সঙ্গে সম্পর্কিত।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশন (বিবিএফ) বিএমআরসির অর্থায়নে ‘Breastfeeding Practices Among Working Mothers in Urban and Rural Bangladesh: A Comparative Study on Barriers, cultural Influences and Policy Impacts’ শীর্ষক একটি গবেষণা সম্পন্ন করেছে। গবেষণাটির প্রধান ফলাফলগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো—
শহরে জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানোর হার বেশি, যা ৮০ দশমিক ৬ শতাংশ, গ্রামে যা ৭৫ শতাংশ।
ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর হার শহরে ও গ্রামে প্রায় সমান, যা ৫৮ শতাংশ।
কর্মস্থলের বাধা শহরের মায়েদের মধ্যে ৭৩ শতাংশ এবং গ্রামে যা ৬৭ দশমিক ৭ শতাংশ।
শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পানের চর্চা অব্যাহত রাখতে কর্মস্থলে নারীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা, অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত মায়েদের জন্য কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন জরুরি।
লেখক: ডা. মো. আবদুল মান্নান: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, নবজাতক বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়