ফুটপাত তুমি আসলে কার
সভ্যতার ক্রমবিকাশে আমরা আজকের আধুনিক জীবনকে পেয়েছি। এর ধারাবাহিকতায় প্রতিটি ধাপে সংঘাত-সংঘর্ষে ঠেকেছি এবং শিখেছি। এর মধ্য দিয়ে নিজেদের পরিবর্তন করে সমানের দিকে চলতে শিখেছি। এই পথপরিক্রমা সহজ ছিল না, তবু বিজয়গাথা রচিত হয়েছে মানুষের। প্রকৃতির সন্তান মানুষ আজ প্রকৃতির অনেক বাধা-বিপত্তি, রোগ-শোক–সমস্যাকে মোকাবিলা করতে শিখেছে।
আদিম গুহায় বাস করার পর্ব পেরিয়ে আমরা চাঁদকে আবিষ্কার করি নবরূপে। এ জন্য পুরো মানবজাতি নমস্য। নৌপথের মাধ্যমে গন্তব্যে পৌঁছানো ছিল দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। সেটি এখন ইতিহাস।
যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে আমরা খুব অল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারি। সে জন্য রয়েছে নৌপথ, রেলপথ, বিমানপথ। আমরা যাঁরা সীমিত পথের যাত্রী, অর্থাৎ গন্তব্য যখন মোহাম্মদপুর থেকে লালমাটিয়া, ধানমন্ডি, শংকর; তাঁদের জন্য এই পথে তিনটি বাহন বা যান রয়েছে—রিকশা, প্রাইভেট কার, টেম্পো।
এ ছাড়া পায়ে হাঁটার স্বাধীনতা তো রয়েছেই। প্রতিটি সড়ক দুই ভাগে বিভক্ত করে নির্ধারিত যান চলাচল সঠিক নির্দেশনাও রয়েছে। তবে বর্তমানে মোহাম্মদপুর থেকে শুরু করে ধানমন্ডি পর্যন্ত প্রায় সারা দিন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তীব্র যানজট একটি বাস্তব ঘটনা।
এই ঘটনার অংশ রিকশা, ভ্যান, বাস, মোটরসাইকেল, টেম্পো ইত্যাদি। এসব যানবাহনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত কিছু রিকশা এবং বাইকচালকদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করেছি দীর্ঘদিন। তাঁরা অন্য যানবাহনের চালকদের তুলনায় একটু বেশিই অস্থির। সবাইকে ফেলে সবার আগে চলার নীতিতে বিশ্বাসী। তাই যানজটে থেমে থাকার সময়ে তাঁদের তীব্র শব্দদূষণে মানুষ অসুস্থ হতে বাধ্য। শুধু তা-ই নয়, প্রতিনিয়ত তাঁরা স্বাধীনভাবে চলে আসে ফুটপাতের ওপর।
চলাকালে পথচারীদের আহত করার ঘটনা যেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে ফুটপাত পথচারীদের হাঁটার পথ, সেখানে থাকে গাছের দোকান, খাবারের দোকান (ভ্যানের ওপর), চায়ের দোকান, সিরামিকের দোকান, ভবনের নির্মাণসামগ্রী। চলে রাস্তা নির্মাণকাজ। আবার ভ্যান-রিকশা-বাইক-সাইকেল সবই যদি চলে আসে ফুটপাতে, তাহলে পথচারীদের চলার পথ কোনটি? সাম্প্রতিক সময়ে হাঁটার সময় আমি একবার এক মোটরসাইকেলচালকের আক্রমণের শিকার হয়েছিলাম। আমার পায়ের ওপর দিয়ে চাকা উঠিয়ে দিয়েছিলেন। তবে তাঁর মধ্যে একটু সৌজন্যবোধ দেখেছি। তিনি মোটরসাইকেল থামিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।
কয়েক দিন আগে কিশোরী পথযাত্রীকে চলার সময় মোটরসাইকেল ধাক্কা দিয়ে দ্রুত চলে যায়। দুর্ঘটনার স্থান ছিল সিটি হাসপাতাল ও আল নূর হাসপাতালের মধ্যখানে। আমরা কয়েকজন পথচারী তাকে সিটি হাসপাতালে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাই। এর কয়েক দিনের মাথায় ছায়ানটের সামনে এক চালক এমন দ্রুত বাইক চালাচ্ছিলেন যে তিন আরোহী তিন দিকে ছিটকে পড়লেন। এর পরের অবস্থা দেখার আর সুযোগ হয়নি।
ঢাকা সিটি হাসপাতাল, আল নূর হাসপাতাল, বাংলাদেশ আই হাসপাতাল—এসব ফুটপাতসংলগ্ন রাস্তার অর্ধেকজুড়ে থাকে প্রাইভেট কার ও মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভদের মোটরসাইকেলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মূল রাস্তার বাইক, রিকশা, সাইকেল। আমার বাসস্থান ও কর্মস্থল এই এলাকায় হওয়ায় প্রায়ই এই পথে চলতে হয়। এসব দুর্ভোগ পোহাতে হয় সব সময়। অনেক দিন এসব চালককে বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করেছি, আপনারা এটা কি ঠিক করছেন?
অনেকে উপেক্ষা করে নিজ গন্তব্যে চলেছেন, অনেকে লাজুক হেসে চলে গিয়েছেন, অনেকে আবার উগ্র আচরণ করেছেন। আমি যেহেতু নিয়মিত এই পথে চলি, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডের কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে চেনেন। কালেভদ্রে সালামও দেন। আমি একদিন বাধ্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এসব অনিয়ম কেন তাঁরা (ওই সব চালকেরা) করেন?
উত্তরে তিনি আমাকে বললেন, তাঁরা আসলে মানুষ না। আমার মনে হলো, পুলিশ কর্মকর্তা হয়তো রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সাত কোটি বাঙালি করে রেখেছো, মানুষ করোনি। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা এটা পাইনি বলে থাকি। আসলে সভ্যতার পথ আমরা নিজেদের কতটুকু সভ্য করতে পেরেছি?
আপন জয়ে জয়ী হয়ে আমরা পুলকিত। সৃষ্টিকে লালন নয়, তা ধ্বংসে আমরা নিমগ্ন। রাজধানীসহ সব জায়গায় জলাশয়, বৃক্ষ নিধন চলছে অবিরত। ২০৫০ সালে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ার আশঙ্কা করেছেন বিজ্ঞানীরা। প্লাস্টিক বর্জ্য আমাদের পরিবেশকে করেছে ভীষণভাবে দূষিত। ফটো কেমিক্যাল স্মোগের জন্য হচ্ছে ওজোন স্তর ধ্বংস। যার উৎস যানবাহনে ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি।
সম্প্রতি মাইক্রো প্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে মৎস্যকুলে। এসব থেকে কি আমরা সতর্ক হব না! আমরা কি জানি না যে বাস্তুসংস্থানের একটি অংশ আমরা, একমাত্র নই। তাই জল, জীব, বৃক্ষ, আকাশ সবই রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। এসবকে লালন করে আমরা চলব, নাকি পথচারীদের পথ দখল করে, আক্রান্ত করে, আহত করে চলার মতোই আমাদের যাত্রা থামবে সর্বত্র?
লেখক: তাপসী বণিক, সহযোগী অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, বিভাগীয় প্রধান, কোডা