কিশোর-কিশোরীদের আচরণ পরিবর্তনের ধরন, কারণ এবং প্রতিকার
রাষ্ট্র গঠনের প্রধানতম চারটি শর্তের মধ্যে প্রথম এবং অন্যতম শর্ত হলো জনগণ। একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন বয়সের মানুষ বাস করে: শিশু, কিশোর, তরুণ, বয়োজ্যেষ্ঠ, প্রবীণ। একটি রাষ্ট্রের কাঠামো এবং অবস্থান কেমন হবে—তা মূলত নির্ধারণ করেন রাষ্ট্রের তরুণ এবং বয়োজ্যেষ্ঠরা; এই দুই শ্রেণির মানুষের চিন্তা, ধ্যান-ধারণার ওপরেই রাষ্ট্রের ভিত তৈরি হয়। সমাজও তার ব্যতিক্রম নয়, এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সমাজও পরিচালিত হয়। সমাজ এবং রাষ্ট্রকাঠামোতে তরুণ এবং বয়োজ্যেষ্ঠ ছাড়াও অরেকটি শ্রেণি খুবই গুরত্বপূর্ণ, যাদের ওপর নির্ভর করে সমাজ এবং রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ। এই গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণির সদস্য হলো কিশোর-কিশোরী। বাংলাদেশের আইন এবং আন্তর্জাতিক আইন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ৯-১৮ বছরের মধ্যে অবস্থান করা সব নাগরিক-ই কিশোর-কিশোরী হিসেবে বিবেচিত হয়।
একটি দেশের, সমাজের সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ যেহেতু অনেকাংশেই এই শ্রেণির ওপর নির্ভর করে, সেহেতু এই গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি নিয়ে রাষ্ট্র এবং সমাজ সব সময় সজাগ এবং সুদৃষ্টি বজায় রাখে। প্রত্যেক প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীরা তাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে একটি কথা প্রায়ই শুনেই থাকে, তা হলো ‘এখনকার ছেলেমেয়েরা কেমন, যেমন, ঠিক আমাদের মতো নয়।’ বয়োজ্যেষ্ঠদের এমন ধারণা অমূলক নয়; বাস্তবেই এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের আচার–আচরণে বেশ পার্থক্য লক্ষ করা যায়, এই পার্থক্য ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুই-ই হতে পারে। তবে ইতিবাচক পার্থক্য রাষ্ট্র এবং সমাজের মাথাব্যথার কারণ না হয়ে বরং আশীর্বাদ হয়। কিন্তু কিশোর-কিশোরীদের আচরণে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটলে তা রাষ্ট্র এবং সমাজের জন্য বিপৎসংকেত। কিশোর-কিশোরীরা স্বভাবতই অন্যদের দ্বারা ভীষণ প্রভাবিত হয়; কারণ, তারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো যথেষ্ট মানসিক সক্ষমতা রাখে না, মূলত ৯-১৮ বছর বয়সটাই এমন।
সে জন্যই মানবজীবনে কিশোর বয়সকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বয়স হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই বয়সে একজন মানুষ যেভাবে গড়ে ওঠে, তার বাকি জীবন ওভাবেই পার হয়। বাংলাদেশের ইতিহাস এবং সমাজকাঠামোর নিজস্ব বয়স তেমন বেশি নয়, ৫০ বছরের বেশি কিছু সময়ের হবে। স্বাধীনতার আগে আমাদের সমাজকাঠামোতে বিভিন্ন দেশীয় সমাজকাঠামোর ছাপ সুস্পষ্ট ছিল; এসব বিবেচনায় আমাদের রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক কাঠামোর খুবই নবীন। তারপরও আমরা যদি কিশোর-কিশোরীদের আচার-আচরণের ৫০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তাহলে আমরা প্রত্যেক প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের আচরণে পূর্ববর্তী প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের আচরণের সঙ্গে বেশকিছু পার্থক্য দেখতে পাই।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা শিশু ছিল, কিংবা যাদের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর আগ থেকে-১৯৮০ সালের মধ্যে, তারা বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রজন্ম কিন্তু কিশোর-কিশোরী হিসেবে প্রথম প্রজন্মের; এই প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের বর্তমান বয়স ৪০-৬০ বছরের মধ্যে। এই প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের প্রতি রাষ্ট্র এবং সমাজ ভীষণ যত্নশীল ছিল; যদিও অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সামগ্রিক বিষয় মিলিয়ে এ প্রজন্মের মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার তেমন সুযোগ পায়নি, তবুও এই প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে কিছু সাধারণ আচরণ দেখা যায়। এই প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীরা বড়দের শ্রদ্ধা করত এবং ভীষণ ভয় পেত। সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মীয় আইনকানুন সব সময়ই মেনে চলার প্রাণপণ চেষ্টা করত। এই প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীরা তাদের পরিবারের প্রতি ছিল যথেষ্ট আন্তরিক এবং দায়িত্বশীল, এই প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীরা যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠে; খেলার মাঠ, রেডিও ছিল তাদের বিনোদনের মাধ্যম। এই প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের সামাজিক বন্ধন ছিল খুবই দৃঢ় এবং বন্ধুত্বের সম্পর্কেও ছিল যথেষ্ট শ্রদ্ধা, আন্তরিকতা।
এই প্রজন্মের পরবর্তী প্রজন্ম—যাদের জন্ম ১৯৮০-১৯৯০ এর মধ্যে; তাদের আচরণে পূর্ববর্তী প্রজন্ম থেকে তেমন বড়সড় কোনো পার্থক্য দেখা যায় না, তবে যেসব পার্থক্য দেখা যায়, তা অত্যন্ত ছোটখাটো পার্থক্য। পূর্ববর্তী প্রজন্ম থেকে এই প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের চিন্তাভাবনা এবং পোশাক–পরিচ্ছদে আধুনিকতার ছাপ লক্ষ করা যায়; এ প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীরা বড়দের শ্রদ্ধা করত, তবে বড়দের সঙ্গে ভয়ের যে সম্পর্ক, তা এই প্রজন্ম কাটিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে মোড় নেয়। তখন পর্যন্তও বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোতে যৌথ পরিবারের বড়সড় প্রভাব ছিল এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কঠোরভাবে কার্যকর ছিল, যার কারণে এই দুই প্রজন্মের আচার–আচরণে তেমন পার্থক্য লক্ষ দেখা যায় না। তবে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে এ প্রজন্মের কিশোর–কিশোরীদের কাছে মাঠের খেলাধুলার পাশাপাশি টেলিভিশন এবং সংবাদপত্র জনপ্রিয়তা লাভ করে।
কিন্তু ৯০ পরবর্তী যাদের জন্ম, অর্থাৎ ১৯৯১-২০০৫ সালের মধ্যে; এই প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে পূর্ববর্তী দুই প্রজন্মের আচার-আচরণে বড়সড় পার্থক্য লক্ষ করা যায়। তারা বাংলাদেশের তৃতীয় প্রজন্মের কিশোর-কিশোরী, এই প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের ‘নাইনটিজ কিড’ নামেও ডাকা হয়। যদিও এই প্রজন্মের শুরুর দিকে (১৯৯১-১৯৯৯) জন্ম নেওয়া এবং শেষের দিকে (২০০০-২০০৫) জন্ম নেওয়া কিশোর-কিশোরীদের আচরণেও অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এ প্রজন্মের জন্ম নেওয়া নাগরিকদের বর্তমান বয়স ১৯-৩০ বছরের মধ্যে। অন্য দুই প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের থেকে এ প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীরা চিন্তাভাবনা এবং ধ্যান–ধারণায় বেশ এগিয়ে তবে নৈতিকতার মানদণ্ডে পূর্ববর্তী দুই প্রজন্ম থেকে বেশ পিছিয়ে। ১৯৯০–এর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যাপক প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা ঘটে এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা অর্জন হয়, যার ফলে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতেও অগ্রগতি দেখা যায়, এর প্রভাব সামাজিক জীবনেও পড়ে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার কারণে টেলিভিশন, মোবাইল, ইন্টারনেট সহজলভ্য এবং হাতের নাগালে এসে পড়ে; সমাজকাঠামোকে প্রভাবিত করার পাশাপাশি কিশোর-কিশোরীদের আচরণকেও প্রভাবিত করে, যার ভালোমন্দ দুই দিকই আমাদের চোখে স্পষ্ট ধরা দেয়। এই সময়ে বাংলাদেশের পারিবারিক কাঠামোতেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে; যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবার গঠনের হিড়িক দেখা যায়, অর্থনৈতিক উন্নতির প্রচেষ্টায় গ্রামের মানুষ শহরমুখী হতে শুরু করে। খেলার মাঠ, রেডিও, সংবাদপত্রের পরিবর্তে কিশোর-কিশোরীদের বিনোদনের জায়গা দখল করে নয়ে টেলিভিশন, কম্পিউটার, মুঠোফোন, ইন্টারনেট।
টেলিভিশন, মোবাইল, ইন্টারনেট সহজলভ্যতার কারণে পুরো বিশ্বের সঙ্গে দেশের মানুষের পরিচয় ঘটতে থাকে, যার ফলে সমাজকাঠামোতে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবও খেয়াল করা যায়। ১৯৯১-১৯৯৯ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া শিশুরা তাদের কিশোর বয়সে বড়দের যথেষ্ট শ্রদ্ধা এবং মান্য করত, সামাজিক ও ধর্মীয় আইনকানুন মেনে চলার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখাত; এসব বিষয়ে তাদের পূর্বসূরিদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। কিন্তু ২০০০-২০০৫–এর মধ্যে জন্ম নেওয়া কিশোরদের ক্ষেত্রে এসব বিষয় অগ্রাহ্য করার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যায়। বড়দের অগ্রাহ্য করার প্রবণতা, সামাজিক আইনকানুন লঙ্ঘনের প্রবণতা এ সময়ের শিশু-কিশোরদের মধ্যে খুবই বেশি। মুঠোফোন, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে খেলার মাঠের বদলে এ প্রজন্মের বিনোদনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলো।
এ ছাড়া কিশোর অপরাধের ব্যাপক বিস্তার লক্ষ করা যায়। ইভটিজিং, কিশোর গ্যাং পরিচালনা, পর্নোগ্রাফি আসক্তি, মাদকাসক্তি... এমনকি কিশোর-কিশোরীদের দ্বারা খুনের মতো জঘন্য ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। যেটা আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজের জন্য বড় অশনিসংকেত হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমাদের উচিত কিশোর-কিশোরীদের আচরণে নেতিবাচক কারণগুলো খুঁজে বের করা এবং সমাধানের চেষ্টা করা। কিশোর-কিশোরীদের আচরণে নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণ হিসেবে মোটাদাগে কয়েকটি বিষয়কে চিহ্নিত করা যায়। এ বিষয়ে সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি অবগত।
বিষয়গুলো হলো—
তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ এবং সহজলভ্যতা
পারিবারিক কাঠামোর ভাঙন
পারিবারিক অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রভাব
সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভাঙন
সন্তান লালন–পালনে মা-বাবার অবহেলা বা অদক্ষতা।
বিষয়টা এমন না যে বর্তমান সময়ের সব কিশোর-কিশোরীদের আচরণে নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়, তবে যাদের আচরণে নেতিবাচক প্রভাবগুলো দেখা যায়, তাদের জন্য ওপরের পাঁচটি বিষয় কোনো না কোনোভাবে দায়ী।
তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ ও সহজলভ্যতা
কিশোর-কিশোরীদের আচরণে নেতিবাচক পরিবর্তনের প্রথম কারণ হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ এবং সহজলভ্যতাকে দায়ী করা যেতে পারে। মোবাইল, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ইন্টারনেট আসক্তি, পর্নোগ্রাফি আসক্তি এবং অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এ ছাড়া ফেসবুক, টিকটকের কুপ্রভাবের কারণে কিশোর-কিশোরীরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে কনটেন্ট ক্রিয়েটর এবং সেলিব্রেটি হওয়ার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকে, যার ফলে পড়াশোনা থেকে পিছিয়ে পড়া, এমনকি পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়ার মতো ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। সে জন্য প্রত্যেক অভিভাবকের তাদের সন্তানদের প্রতি তদারকি বাড়ানো প্রয়োজন। নির্দিষ্ট বয়স ছাড়া সন্তানদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেওয়া উচিত নয়। কিশোর-কিশোরীরা মুঠোফোনে দিয়ে কী ব্যবহার করছে, কিংবা কী দেখছে, সে বিষয়েও খোঁজ রাখা ভীষণ প্রযোজন। কিশোর-কিশোরীদের স্মার্টফোন ব্যবহারে অভিভাবকেরা তদারকি বাড়ানোর জন্য বিশেষ কিছু সফটওয়্যারও ব্যবহার করতে পারে; গুগল ফ্যামেলি লিংক সফটওয়্যারের মধ্য দিয়ে অভিভাবকেরা কিশোর-কিশোরীদের স্মার্টফোন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
পারিবারিক কাঠামোর ভাঙন
বাংলাদেশের পারিবারিক কাঠামোতে যখন যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গড়ে উঠতে শুরু করে, তখন থেকে কিশোর-কিশোরীদের আচরণেও অসামঞ্জস্যতা ফুটে ওঠে। যৌথ পরিবারে কিছু অসুবিধা আছে, তা সত্য, তবে অসুবিধার চেয়ে সুবিধাই বেশি। খেয়াল করলে দেখা যায়, যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশু–কিশোরেরা একক পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশু–কিশোরদের চেয়ে সবদিকেই এগিয়ে থাকে। এর কারণ হলো শিশু–কিশোরেরা পরিবারের সব সদস্যের সংস্পর্শে থাকে এবং সবার কাছ থেকে জানার সুযোগ লাভ করে, এ ছাড়া যৌথ পরিবারের শিশু–কিশোরদের দায়িত্ব, নিয়ন্ত্রণ মা–বাবা ছাড়াও পরিবারের অন্য সদস্যের (দাদা, দাদি, চাচা, ফুফু) কাছে থাকে; বহুমুখী নিয়ন্ত্রণের কারণে শিশু–কিশোরদের বিপথে যাওয়ার সুযোগ কম থাকে; যার ফলে শিশু–কিশোরদের সুষ্ঠু মানসিক বিকাশ ঘটে। শিশু–কিশোরদের মা–বাবা সন্তানের ব্যাপারে উদাসীন হলেও পরিবারের অন্য সদস্যরা সে বিষয়গুলো পুষিয়ে দিতে চেষ্টা করে।
ফলে শিশু–কিশোরদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন খুবই দৃঢ় হয়, শিশু–কিশোররা সামাজিক নিয়মকানুন, ধর্মীয় আচার-আচরণ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সহজেই আয়ত্ত করে নিতে পারে। অন্যদিকে একক পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশু–কিশোররা এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়, যার ফলে শিশু–কিশোরদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া খুবই মন্থর হয়। এর প্রভাব শিশু–কিশোরদের আচরণেও প্রভাব ফেলে। সবার সঙ্গে মিশতে না পারা, সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরিতে ব্যর্থ হওয়ার মতো ঘটনা একক পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশু–কিশোরদের মধ্যে দেখা যায়, যার ফলে শিশু–কিশোরেরা হতাশ এবং অবসাদে ভুগে নানা রকম নেতিবাচক কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে। যেহেতু একক পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশু–কিশোরদের নিয়ন্ত্রণ শুধু তাদের মা-বাবার কাছে থাকে সে ক্ষেত্রে এই নিয়ন্ত্রণ যদি কোনোভাবে ভেঙে পড়ে তাহলে শিশু–কিশোরদের অবস্থা লাগামহীন ঘুড়ির মতো হয়ে যায়।
পারিবারিক অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রভাব
পারিবারিক অর্থনৈতিক কাঠামো ও কিশোর-কিশোরীদের আচরণ নিয়ন্ত্রণে প্রভাব রাখে। দারিদ্র্যতা যেমন কিশোর-কিশোরীদের সুষ্ঠু বিকাশে বাঁধা তৈরি করে, ঠিক তেমনি অর্থনৈতিক প্রাচুর্যও কিশোর-কিশোরীদের বখে যেতে সহায়তা করে। এই বিষয়ে অভিভাবকদের মাথায় রাখা উচিত। কিশোর-কিশোরীদের আরাম–আয়েশে বড় না করে অভাববোধ বোঝানোও জরুরি, যার মধ্য দিয়ে কিশোর-কিশোরীরা জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে নিতে পারবে এবং বড় হওয়ার অনুপ্রেরণাও খুঁজে পাবে। অর্থনৈতিক প্রাচুর্য শিশু–কিশোরদের কীভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে ‘ঐশী রহমান’; ২০১৩ সালে ঐশী রহমানের হাতে তার মা–বাবা নির্মমভাবে খুন হন; বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি কালো অধ্যায়। আবার অর্থনৈতিক অপ্রাচুর্যও কিশোর-কিশোরীদের বিকাশকে ব্যাহত করে। অর্থনৈতিক অপ্রাচুর্যের কারণে কিশোর-কিশোরীরা পড়াশোনা এবং যাবতীয় মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, যার কারণে কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে অপরাধ প্রবণতা বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। রাষ্ট্র এবং সমাজের মানুষকে এ বিষয়ের দিকেও নজর রাখা জরুরি।
সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভাঙন
সামাজিক প্রতিষ্ঠান বলতে বিভিন্ন সামাজিক ক্লাব, পাঠাগার, মক্তব ইত্যাদিকে বোঝানো হয়ে থাকে। একটা সময় দেখা যেত প্রতিটি সমাজে কোনো না কোনো ক্রীড়া ক্লাবের (স্পোর্টিং ক্লাব) দেখা মিলত; কিশোর-কিশোরীদের খেলাধুলার আয়োজন ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করত; এসবের মধ্য দিয়ে সামাজিক সংহতি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হতো; কিন্তু এসব সামাজিক ক্লাবের অনুপস্থিতি বর্তমানে আমাদের সমাজে প্রকটভাবে ধরা দিচ্ছে। খেলাধুলা একদিকে শিশু–কিশোরদের একদিকে যেমন মানসিক এবং দৈহিক বিকাশে সহায়তা করে, অন্যদিকে মাদক থেকে দূরে রাখে, এর ফলে সমাজ উপকৃত-ই হয়। একটা সময় প্রতিটি গ্রামেই মক্তবের প্রচলন ছিল শিশু-কিশোররা মক্তবে ধর্মীয় রীতিনীতি, আচার-আচরণ, নৈতিক শিক্ষা লাভ করত; সময়ের প্রেক্ষাপটে মক্তবের মতো এত সুন্দর এক প্রতিষ্ঠান আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে, যার ফলে শিশু-কিশোরদের ধর্ম এবং নৈতিকতা শেখার স্থানও সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। বর্তমান সময়ে এসে সমাজের প্রাজ্ঞজনদের এ বিষয়ে পুনরায় চিন্তাভাবনা করা দরকার। এ ছাড়া প্রতিটি সমাজে পাঠাগারের ব্যবস্থা রাখা জরুরি, যাতে করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য জ্ঞানের সঙ্গেও পরিচিত হতে পারে এবং নিজেদের সুষ্ঠু বিকাশ ঘটাতে পারে।
সন্তান লালন–পালনে মা–বাবার অদক্ষতা
কিশোর-কিশোরীদের আচরণে নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণ হিসেবে সন্তান লালন-পালনে মা–বাবার অদক্ষতাকেও দায়ী করা যেতে পারে। কিশোর-কিশোরীদের অতিরিক্ত শাসন, অযথা গায়ে হাত তোলা, গালিগালাজ করা, বিনা কারণে ছোট করা, অন্যের সঙ্গে তুলনা করা ইত্যাদি এসব কারণ কিশোর-কিশোরীদের আচরণে যথেষ্ট নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশে বাধাগ্রস্ত করে। কিশোর-কিশোরেরা ভুল করলে মা–বাবার উচিত সন্তানদের সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেওয়া, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সন্তানদের ভুলগুলো তুলে ধরা। মা–বাবা যদি সন্তানদের সঙ্গে ভালো আচরণ করেন এবং নমনীয় হন, তাহলে সন্তান এবং মা-বাবার মধ্যে হৃদ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়। মা-বাবার প্রতি সন্তানদের শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়। এ ছাড়া কিশোর-কিশোরীরা কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে, কার সঙ্গে মিশে, ঠিকমতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায় কি না, পড়াশোনায় মনোযোগী কি না ইত্যাদি বিষয়ে মা-বাবার খোঁজখবর রাখা জরুরি। কোনো বিষয়ে সন্তানদের সন্দেহের চোখে না দেখে সন্তানদের সঙ্গে খোলাখুলি আলাপ করাই উত্তম।
কিশোর-কিশোরীরা রাষ্ট্র এবং সমাজের ভবিষ্যৎ কারিগর। কারিগর যদি দক্ষ না হয়, তাহলে স্থাপনাও নড়বড়ে হবে, তেমনি কিশোর-কিশোরীরা যদি ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে না ওঠে, তাহলে রাষ্ট্র এবং সমাজের ভিতও নড়বড়ে হয়ে পড়বে এবং সবকিছু অচল হয়ে পড়বে। সে জন্য রাষ্ট্র এবং সমাজের উচিত জাতির এই ভবিষ্যৎ কারিগরদের দিকে সব সময় সুদৃষ্টি রাখা এবং তাদের পরিপূর্ণ বিকাশে সাহায্য করা।
লেখক: অর্বাচিন আব্দুল্যাহ, শিক্ষার্থী, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স, চট্টগ্রাম বিশ্বাবিদ্যালয়
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস: [email protected]