বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত সংস্কার হোক গবেষণা খাত বিনির্মাণ
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান তৈরির উৎকৃষ্ট স্থান, যেখানে জ্ঞান বিতরণের মাধ্যমে তৈরি হন আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগরেরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় আবদ্ধ থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা হয় মননে, চিন্তার প্রসারে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ব্যবহারিক কৌশলের ভিত্তিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতককালীন সময়ে একজন শিক্ষার্থী নিজেকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করার সুযোগ পান। এই বিকাশের ক্ষেত্র বহুমাত্রিক। কারণ, একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচিতে আবদ্ধ থাকেন না, তাঁর মস্তিষ্কে চিন্তাভাবনার জগৎ বড় হয়, বুঝতে পারেন তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রস্থল। এই কেন্দ্রস্থলেই শিক্ষার্থীর সার্বিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও শিক্ষার্থীভেদে এই পরিবর্তন তৈরি হয় তাঁর আগ্রহ ও অনুশীলনের ওপর। এভাবেই স্নাতককালীন সময়ে একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে রোপিত হয় গবেষণার প্রতি আগ্রহ। গবেষণা প্রকাশ করার স্পৃহা জন্মায়। গবেষণাপ্রক্রিয়া হচ্ছে একটি নিয়মতান্ত্রিক ব্যবহারিক প্রশিক্ষণযোগ্য পাঠ, যা যথাযথ নিয়ম ও শৃঙ্খলা অনুসরণ করে সম্পন্ন করা হয়।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে প্রতিটি কাজ হচ্ছে গবেষণানির্ভর, যা তাদের দেশগুলোর ভিত্তিপ্রস্তর শক্তিশালী করে, অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড মজবুত করে এবং দেশের কাঠামোব্যবস্থার আধুনিকায়ন করে গতিশীল রূপ প্রদান করে। দেশগুলোর উন্নয়নের গ্রাফ তৃতীয় বিশ্বের সঙ্গে স্থিতিশীল অবস্থায় রাখতে সঠিক গবেষণাপত্র নির্মাণের গুরুত্ব অপরিসীম, যা নির্ভরতা দেয় দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তিগুলোকে। এতে অর্থনৈতিক চালিকাশক্তিগুলো মূল্যায়িত হয়ে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে দেশের ইতিবাচক অবস্থান বজায় রাখে।
২০২৩ সালে স্কোপাস ইনডেক্স জার্নালে বাংলাদেশ থেকে ১৩ হাজার ২২৭টি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, যা ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে কম। মোদ্দাকথা, সঠিক গবেষণাপত্র নির্মাণ উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সুস্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করে দেবে।
সম্প্রতি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন, যা তাঁদের শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোগত পদ্ধতির সুফল। আমাদের দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও এই গবেষণা খাত দুর্বল হওয়ার ফলে বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা তথৈবচ। বিগত কয়েক বছরে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বরং সেটা না করে স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিকল্পনা অনুসরণ করে প্রতিষ্ঠিত করা শ্রেয় ছিল। এর মধ্যে এমনও বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে পুরো বছরে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়নি, যা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য হতাশাজনক।
কিন্ত দুঃখজনক হলেও আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো গবেষণাবান্ধব পরিবেশ ও সংস্কৃতি সেভাবে গড়ে ওঠেনি। উন্নত বিশ্বের শিক্ষার্থীরা গবেষণাকে অধিক প্রাধান্য দিলেও আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা তার ঠিক বিপরীত। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা গবেষণাকর্মের তুলনায় একাডেমিক, বিসিএসসহ সরকারি চাকরির পড়াশোনায় অধিক গুরুত্বা আরোপ করেন। বিশ্বের বড় বড় টেক জায়ান্টসহ প্রথম সারির প্রথিতযশা প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্ব যেসব শিক্ষার্থীরা দেন, তাঁদের এই স্থানে নেতৃত্ব দেওয়ার অন্যতম কারণ গবেষণামূলক দক্ষতার জ্ঞান অর্জন, যা তাঁদের বাকি শিক্ষার্থীদের থেকে আলাদা করে।
একটি মানসম্মত গবেষণাপত্রও দেশের খোলনলচে বদলে দিতে পারে, সেই দিকে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। তা ছাড়া গবেষণার প্রতি আগ্রহী শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত সুযোগ–সুবিধার অভাবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। আবার শিক্ষকদেরও গবেষণারমূলক কাজের হার তুলনামূলকভাবে বেশ কম। এমনকি শিক্ষকেরা গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি করে সেটা নিজের প্রকাশনা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। এর ফলে আমাদের গবেষণার ভিত্তিস্তর আরও নড়বড়ে ও দুর্বল হচ্ছে। এর ফল ভোগ করতে হয় সাধারণ শিক্ষার্থীসহ সবাইকে।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সংস্কার করতে শিক্ষার্থীদের গবেষণার প্রতি আগ্রহী করতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্চনীয়। শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ বিষয়ভিত্তিক গবেষণার প্রতি আগ্রহী করতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষকের গবেষণা থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে। পাশাপাশি বছরে নির্দিষ্টসংখ্যক গবেষণা প্রকাশনা নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষকদের। শিক্ষার্থীদের গবেষণামুখী করতে লোভনীয় সুযোগ–সুবিধা প্রদান করতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন স্কলারশিপ, ফেলোশিপসহ আর্থিক সহায়তা বাড়াতে হবে।
দেশে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় বাজেটে গবেষণার জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। নিয়মিত সেমিনার, কর্মশালার আয়োজন করতে হবে। স্বল্পমূল্যে বা বিনা মূল্যে গবেষণাভিত্তিক বিভিন্ন কোর্স প্রদান করতে হবে, যাতে সহজে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারেন। এতে শিক্ষার্থীদের গবেষণার প্রতি জ্ঞান ও দক্ষতার বিকাশ ঘটবে। এর ফলে দেশীয় গণ্ডি পার হয়ে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তির ইতিবাচক পরিবর্তন আরও সাধিত হবে।
লেখক: শাহ মুনতাসির হোসেন মিহান, শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]