বৃষ্টিভেজা ভালোবাসায়
১.
চারদিকে প্রবল বৃষ্টি পড়ছে। নিহাদ ও তার বন্ধুরা মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের সামনে বৃষ্টিফি নিচ্ছে, আর দুষ্টুমি করছে। হঠাৎ নিহাদের চোখ পড়ে ইলেকট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে। মেয়েটির উৎসুক চোখ কী যেন খুঁজে ফিরছিল। নিহাদ মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায়।
নিহাদ: হ্যালো, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন? (চশমার ফাঁকে আড়চোখে মেয়েটি তাকায়)
মেয়েটি: এই মুহূর্তে একটি ছাতা খুঁজছি।
(নিহাদ ঝটপট কাঁধ থেকে ব্যাগ খুলে ছাতাটি এগিয়ে দেয়)
এই নিন।
থ্যাংকস, বাট লাগবে না।
কেন? ছাতা সুন্দর নয়?
আসলে তা নয়, এই যুগের ছেলেদের আমার চেনা আছে, প্রথমে কিছু দিয়ে নাম জিজ্ঞাসা করা, তারপর নিজে থেকে ফ্রেন্ডশিপ করা, তারপর ফ্রেন্ডশিপ টাকে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়া। তা ছাড়া আপনি অপরিচিত।
ও হ্যালো, আপনি কয়টা ছেলে দেখেছেন কে জানে, আমি ওদের মতো নই, জাস্ট মানবতার খাতিরে আপনাকে হেল্প করতে আসলাম।
(মেয়েটি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এর মধ্যে একটি মেয়ের আগমন)
‘এই অদিতি, কোথাও ছাতা পেলাম নারে, যা বৃষ্টি, আমার এই ছোট ছাতায় তো দুজন যেতে পারব না।’
আচ্ছা অরিন তুই যা।
(অরিন নামের মেয়েটি চলে যাচ্ছে। অদিতি অসহায়ের মতো একবার অরিনের দিকে আরেকবার নিহাদের হাতের ছাতার দিকে তাকাচ্ছে, ব্যাপারটা নিহাদ খুব উপভোগ করছিল)
নিহাদ: আরে, আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি কেন, আমি যাই কেমন? নিহাদ ঘুরে হাঁটা দেয়।
‘ছেলেটা তো ভালোই ছিল, কত সুন্দর উপকার করতে এল, আর আমি কিনা ভাব দেখালাম, ধুর...আপন মনে বলছে অদিতি। অদিতির এখন নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। ইতস্তত করতে করতে সে নিহাদকে ডাক দেয়
এই যে।
(মুচকি হেসে, নিহাদ শুনতে পেয়েও না শোনার ভান করে চলে যাচ্ছে, ওকে দাঁড়াতে না দেখে অদিতি আবার ডাক দেয়।
এক্সকিউজ মি, হ্যালো...
(এবার নিহাদ দাঁড়ায়, হাসিটা আড়াল করে গম্ভীর মুখে ঘুরে দাঁড়ায়)
আমাকে ডাকছেন?
হে আপনাকেই, আশপাশে তো আর কেউ নেই।
আমি তো আশপাশে অনেককেই দেখতে পাচ্ছি।
আমি আপনাকে যে শ্রাব্যতার সীমার মধ্যে দেখেছি, তার পাশে কেউ নেই।
ও আচ্ছা, তা ডেকেছেন কেন?
ইয়ে মানে আপনার ছাতাটা দেওয়া যাবে? (ইতস্তত করতে করতে)
কেন এখন কি আর আমি অপরিচিত নই? আর কী যেন, হ্যাঁ ফ্রেন্ডশিপ...তারপর...
আরে দিন না, এত কথা বলছেন কেন? (ধমকের সুরে বলে ওঠে অদিতি)
নিহাদ আর কিছু না বলে ছাতাটা দিয়ে দেয়। ছাতা হাতে দ্রুত চলে যাচ্ছে অদিতি।
‘আচ্ছা, হিজাব পরিহিত চশমা পরা শ্যামবর্ণের মেয়েটি সেই ছোটবেলার অদিতি না তো?’ আপন মনে বলছে নিহাদ। এতক্ষণ দূর থেকে সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করছিল শামিম, এবার এগিয়ে আসে।
শামিম: দোস্ত মেয়েটা কে রে, এভাবে রবির মতো জ্বলে উঠল, আর তুই কিছুই বললি না।
নিহাদ: ওকে মনে হয় আমি চিনি।
তাই নাকি? কে সে?
অদিতি রাহিয়া, আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
২.
অনেক দিন পর ছোটবেলার বন্ধুকে দেখতে পেয়ে নিহাদ ফিরে গেল শৈশবের সেই দিনগুলোতে। একসঙ্গে খেলা করা, প্রাইভেট পড়তে যাওয়া, ক্লাসে পড়া নিয়ে প্রতিযোগিতা। প্রাইমারি জীবনের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে সবাই আলাদা আলাদা হাইস্কুলে ভর্তি হওয়া। সময়ের পরিবর্তনে একসময় অদিতির স্মৃতি চাপা পড়ে যায়। আজ আবার সেই অদিতিকে দেখে আগের কথা মনে পড়ে গেল। অদিতির সবকিছু বদলে গেলেও রাগটা এখনো আগের মতোই আছে।
পরদিন ক্লাসে অদিতি ছাতা হাতে নিহাদের দিকে এগিয়ে আসে।
অদিতি: তোমার ছাতাটা।
নিহাদ: থ্যাংকস...তুমি!
হুম, একই ক্লাসে পড়ছি যখন, তুমি বলতে প্রবলেম কী?
প্রবলেম নেই, তুমি কি আজকেই ভর্তি হয়েছ?
নাহ, ওরিয়েন্টশন ক্লাসে আসতে পারিনি।
ওহ! যা–ই হোক, আজকে ছাতা এনেছ?
হুম...(অদিতি মুচকি হাসি দিয়ে চলে যায়)
তারপর একসঙ্গে প্রাইভেট, কোচিং, ক্লাস—সবকিছু যেন সেই আগের মতোই চলতে লাগল, মজার ব্যাপার হলো অদিতি এখনো নিহাদকে চিনতে পারেনি। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
ছুটির দিনে বিকেল বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠে ক্যাম্পাসের বকুলতলায়।
নিহাদ: আচ্ছা আমি যা দেখি, তুমি কি তা দেখো?
অদিতি: তুমি কী দেখো?
আমি দেখি, তোমার ওই চোখে আমার পৃথিবী, অসীম মমতা, একটু লাজুকতা আর মিষ্টি চাহনি।
চোখ তো চোখই, চোখে এসব দেখার কী আছে?
কিছুক্ষণ পর...
আচ্ছা, আমি যা দেখি, তুমি কি তা দেখো?
কী দেখো? আমি দেখি, তোমার মুখের মিষ্টি হাসি, আর ঠোঁটের নিচের তিল, আর মেকাপের ওপর জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম। আর দেখি...
থামো, আর বলতে হবে না।
অদিতির রাগের কণ্ঠ শুনে নিহাদ কিছুক্ষণ চুপ করে আবার বলে...
আচ্ছা আমি যা দেখি...
কী দেখো তাড়াতাড়ি বলো, এত ভাব করে বলতে হবে না।
অদিতির চোখে আরও বিরক্তি দেখে নিহাদ এবার প্রকৃতির আশ্রয় নেয়।
আমি দেখি ওই নীল আকাশ। সেখানে দেখি মেঘেদের আনাগোনা, তাদের একেকটার রূপ আকাশের ক্যানভাসে এঁকে চলে নানা প্রতিকৃতি।
আকাশ তো আকাশই, এভাবে আকাশ দেখার কী আছে?
এবার হাল ছেড়ে দিয়ে নিহাদ চুপ করে রইল।
কী ব্যাপার, চুপ করে আছ কেন? এই নিহাদ...(ধাক্কা দিতে দিতে বলল অদিতি)
তারপরও নিহাদকে চুপ করে থাকতে দেখে পাশ থেকে উঠে নিহাদের বাঁ গালে ঠাস করে চড় মারে। আকস্মিক চড় খেয়ে নিহাদ বিস্মিত আর ব্যথিত। চড় খেয়ে নিহাদ ভাবছে, কী মেয়েরে বাবা! সবার সামনে এভাবে চড় মারতে একটুও দ্বিধা বোধ করল না! বন্ধুরা কী যেন একটা বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করছিল, ঠাস শব্দ শুনে সবাই চুপ করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই অদিতিকে অনেক ভয় পায়।
নিহাদ: একি, তুমি আমাকে চড় মারলে কেন?
অদিতি: এত কবি কবি ভাব নিয়ে ঢং করে কথা বলছ কেন? ঢং আমি একদম সহ্য করতে পারি না।
আমি তো শুধু মজা করছিলাম।
আর কোনো কথা বলবা না।
ঠিক আছে।
বলেই নিহাদ সেখান থেকে উঠে পড়ে।
৩.
বাসায় ফেরার পর অদিতি ওর ব্যাগে একটি ডায়েরি খুঁজে পায়। অদিতি ডায়েরিটা খোলে।
ডায়েরির লেখা: ‘চারদিকে প্রবল বৃষ্টি, এমন বৃষ্টিভেজা বিকেলে আজকে অদিতিকে প্রথম দেখলাম ক্যাম্পাসে। ওর উৎসুক চোখ একটি ছাতা খুঁজছিল। আমার ছাতাটি ওকে দিলাম, প্রথমে নিতে চায়নি। সেদিন ওর সঙ্গে প্রথম কথা হলো, সেদিনের অদিতি আর আজকের অদিতির মধ্যে তফাত থাকলেও রাগের মধ্যে কোনো তফাত ছিল না। সেই আগের মতো যখন–তখন রাগ করে লাল হয়ে যাওয়া, আর ঠাস করে চড় মারা অদিতি। তবুও কেন জানি অদিতিকে আমার ভালো লাগে, অনেক অনেক ভালো লাগে। ওর রাগ আমার কাছে ভালোবাসার অনুভূতি মনে হয়, ওর দেওয়া আঘাত ভালোবাসার স্পর্শ মনে হয়। অনেক রাগী হলেও ওর রাগ বেশিক্ষণ থাকে না, রাগী মানুষেরা তো অনেক বেশি ভালবাসতে পারে। আমার অদিতির মনেও অনেক ভালোবাসা লুকিয়ে আছে, তা সে প্রকাশ করতে চায় না। হয়তো লুকিয়ে রেখেছে আমার জন্য। সেই লুকানো ভালোবাসা আমি খুঁজবই। সেদিনের হারিয়ে যাওয়া অদিতিকে যখন এত দিন পর খুঁজে পেয়েছি, ওর ভালোবাসাও খুঁজে পাব। এত দিনের জমানো ভালোবাসা অদিতিকে উজাড় করে দেব। কী করে বলব, তোমায় কতটা ভালোবাসি। অদিতিকে আপন করে পাওয়ার জন্য হাজারটা চড় খেতে রাজি, শত কষ্ট সহ্য করতে রাজি। যেভাবেই হোক, আমি অদিতির মন জয় করবই করব।’
লেখাগুলো পড়তে পড়তে অদিতির চোখ ভিজে ওঠে।
পরদিন ক্যাম্পাসে নিহাদের পথ আটকে দাঁড়ায় অদিতি।
এগুলো তুমি লিখেছ, তাই না?
নিহাদ চুপ করে আছে।
কী হলো, কিছু বলছ না কেন?
কী বলব?
আমাকে এত ভালোবাসো কেন?
জানি না।
সত্যি জানো না?
হুম।
একটা থাপ্পড় মারব কিন্তু...
বলছি বলছি। উত্তর একটাই, ভালোবাসার জন্য ভালোবাসি, তোমাকে ভালোবাসা দেব বলে ভালোবাসি।
নিহাদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে অদিতি। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলতে থাকে...
তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি নিহাদ। প্লিজ, আমাকে মাফ করে দাও। আর কখনো তোমাকে আঘাত করব না।
আড়াল থেকে বন্ধুরা সবাই চিৎকার করে হাততালি দিয়ে ওঠে।
নিহাদ: এই ডায়েরি তোমার কাছে কীভাবে গেল?
অদিতি: নিশ্চয় তুমি রেখেছ?
শামিম: ডায়েরি রাখার পরিকল্পনা ছিল আমার। নয়তো এই ব্যাটা জীবনেও মুখে বলতে পারত না।
অরিন: চল, এই সুন্দর মুহূর্তটাকে ফ্রেমবন্দী করে রাখি।
সবাই একসঙ্গে সেলফি নেয়। হঠাৎ ঝুমবৃষ্টি নামে, কিছুক্ষণের ভেতর তা রূপ নেয় প্রবল বর্ষণে। বৃষ্টিভেজা ভালোবাসা যেন আজ পূর্ণতা পেল।
লেখক: নাহিদ হোসাইন, কবি ও কথাসাহিত্যিক, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ।
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]