টাঙ্গন বহিয়া যায়...

টাঙন নদীছবি: লেখকের পাঠানো

শওকত আলীকে যাঁরা পড়েন, তাঁরা টাঙ্গন নদীর নাম শুনে থাকবেন হরহামেশাই। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের 'প্রদোষে প্রাকৃতজন'খ্যাত লেখক নিজে টাঙ্গনতীরের সন্তান, তাই রচনাতেও নিয়মিত রেখে গেছেন তার ছাপ। যদিও নামের শেষে 'আ' বা 'ই' প্রত্যয় না থাকায় টাঙ্গনের 'নদ' হবার কথা, তবে জনপ্রিয় প্রচলনের ফলে নদী হিসেবেই ডাকা হয় তাকে। উত্তর জনপদের অন্যতম প্রাচীন স্রোতধারা এ টাঙ্গন নদী।

পঞ্চগড় সদরের মাগুরা ইউনিয়নের আবাদি জমি থেকে উৎপত্তি টাঙ্গন নদীর৷ অবশ্য আজও স্রোতধারার আধো-মোছা চিহ্ন বলে, এ নদীর উৎপত্তি আরেকটু এগিয়ে ওপার বাংলার জলপাইগুড়িতে। পঞ্চগড়,ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর- ২৫ মাইলের কিছু বেশি পথ বৃহত্তর দিনাজপুরের ওপর দিয়ে অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করে টাঙ্গন। এরপর আবারো চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে বাংলাদেশে এসেই পূনর্ভবা নদীতে জলদান করে। নিজে পূনর্ভবার উপনদী হলেও, এর কিন্তু উপনদী অনেক - শুক,লাচ্ছি,সেনুয়া, সুয়া প্রভৃতি। 

ঠাকুরগাঁও শহরে পানিশূন্য নদীতে ময়লার ভাগাড়।
ছবি: লেখকের পাঠানো

গ্রামের শান্ত স্নিগ্ধ মেয়েটির মতো নিঃশব্দে বয়ে চলে টাঙ্গন। পথে পথে নদীটি বিছিয়েছে মোহনীয়তার পসরা। অগভীর হওয়ায় প্রায় সবখানেই হাঁটুজল থাকে তার। আগের মতো স্রোত নেই, তাই খুব বেশি মাছও নেই নদীতে। তবে তাই বলে কিন্তু নদী ঘিরে ব্যস্ততা কম নয়। গ্রামের মানুষের নিত্যদিনের স্নানাদি, গবাদি পশুর অবগাহন,ছেলেদের হুটোপুটি লেগেই থাকে নদীজুড়ে। এ যেন হাজার বছরের অলিখিত পরম্পরা। বিভূতিভূষণের চোখে ইছামতী যেমন,শওকত আলীও তেমনিভাবে এঁকেছেন টাঙ্গনকে। তাতে অতিরঞ্জন কিচ্ছুটি নেই, এই আবহমান বাংলা, যাপিত জীবন, নিঃশব্দে ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করা টাঙ্গনের জল - সবটাই যথাযথ বাস্তব। 

এ অঞ্চলে এককালের ভূপতি রাজা টঙ্কনাথের নাম থেকে টাঙ্গন নদীর নামকরণ - স্থানীয়দের দাবি এ-ই। তাঁর রাজবাড়িটি এখনও আছে। সে যাই হোক, টাঙ্গনের সঙ্গে জুড়ে আছে আরও অনেক নাম, আরও অনেক আলাপ। দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলায় সাদামহল গ্রামে এ নদীর তীরে জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়ে গেছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা উইলিয়াম কেরি। নদীতীরে তাঁর পুত্রের কবর আজও আছে। টাঙ্গন নদীর পলিতে গড়ে উঠেছে উত্তরের ছিমছাম নিভৃত শহর ঠাকুরগাঁও। শহরকে দুভাগ করে টাঙ্গন বয়ে গেছে একেবারে মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ নদী রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। টাঙ্গন নদীর ওপর করা হয়েছে টাঙ্গন বাঁধ,বোচাগঞ্জের রাণীর ঘাট রাবারড্যাম, সাগুনী রাবার ড্যামসহ বেশ কিছু সেচ প্রকল্প। পীরগঞ্জ উপজপলায় বুনো নদী টাঙ্গনের তীরে বেড়ে উঠেছে মনোরম সাগুনী শালবন। ঠাকুরগাঁও থেকে অনতিদূরে নদীটির কোল ঘেষে গড়া হয়েছে লোকায়ন জীববৈচিত্র্য যাদুঘর। সে জাদুঘর যেন নদীর সঙ্গে বয়ে চলা শতবর্ষের সংস্কৃতিই ধারণ করে আছে। এখানেই আছে বাংলাদেশের একমাত্র নদী মিউজিয়াম। আছে হারিয়ে যাওয়া বাঙালি সংস্কৃতির দুর্লভ সব সংগ্রহ। 

বছর দুয়েক আগে বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে খনন করা হয়েছে নদীটি।কাজেই খুব আশা নিয়ে তাকে দেখতে গিয়েছি। তবে শেষমেশ সন্দেহ যা ছিলো, তাই হয়েছে। ক্লাসের সবচেয়ে নাছোড়বান্দা দুষ্টু ছেলেটির মতোন নদী খননের নামে এবারও শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়ে গেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কাগজে কলমে প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়ে গেলেও নদী খননের কোনো চিহ্নই অবশিষ্ট নেই। খননকৃত সব বালু নদীর পাড়েই রাখায় তা আবারো ধুয়ে নদীতে গেছে। সীমানা নির্ধারণ না করায় দখলে দূষণে জেরবার নদীটি। উল্টো ঠাকুরগাঁও শহরের ভাগাড় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে টাঙ্গন। শহর থেকে অদূরে প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নদীর ওপর করা হচ্ছে পার্ক। উপনদীগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। শুক, সেনুয়া,লাচ্ছির দিকে তাকানোই যায় না।

নদী দখল করে অবৈধ স্থাপনা
ছবি: লেখকের পাঠানো

বছর বছর বাজেট করে সরকারের অর্থ জলাঞ্জলি দেয়ার কোনো মানে হয় না। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে তার চরিত্র বদলাতে হবে। এভাবে একের পর এক নদী খননের নামে নদী হত্যার মশকরা বন্ধ করতে হবে। উত্তরবঙ্গের হারিয়ে যেতে বসা নদীগুলোর প্রত্যেকটির জন্য পরিকল্পিত খনন কার্যক্রম দরকার দু-এক বছরের মধ্যেই। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়,নদী রক্ষা কমিশন,পাউবো,বিএনডিসি, স্থানীয় সরকার - কেবল নদী নিয়ে এতগুলো প্রতিষ্ঠান থাকার পরও যদি এভাবে মানচিত্র থেকে দেশের জননীদের মুছে যেতে হয়, তাহলে 'এই আমলাতন্ত্র দিয়া আমরা করিব কী?'

অবিলম্বে দীর্ঘ সংস্কারের সুদীর্ঘ পরিকল্পনায় টাঙ্গনের মতো নদীগুলোর ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যার অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। এ আর অনুরোধ নয়, পাওনা দাবি।

  • শাফায়াত স্বচ্ছ আহ্বায়ক রিভারাইন পিপল ক্লাব,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়