চাপা পড়ে আছে চারমাথা মোড়ের ইঁদারার ঐতিহ্য
ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে—কুড়িগ্রাম জেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের ডাকিনীর পাটগ্রামের চারমাথা মোড়ের ইঁদারাটি। প্রায় এক শ বছর আগে ভেতর বন্দের জমিদার প্রতিভা বালা চৌধুরী এটি খনন করেন। ইঁদারাটির সুমিষ্ট পানি স্থানীয় জনসাধারণের সুপেয় পানির অভাব পূরণসহ রান্নাবান্না, ঘর-গৃহস্থালির নানা কাজে ব্যবহৃত হতো। ইঁদারার সামনের জায়গাটি ব্যবহার করা হতো খেলার মাঠ হিসেবে। প্রতিদিন স্থানীয় এবং বিভিন্ন জায়গার লোক আসত খেলা দেখতে। এসব লোকের পদভারে মুখরিত থাকত ইঁদারার আশপাশ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে সে চিত্র। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে যেমন একসময়ের খেলার মাঠটি পরিণত হয়েছে খড়ের স্তূপ আর গরু চরার মাঠে। পাশাপাশি হারিয়ে যাচ্ছে শত বছরের পুরোনো এ ইঁদারাটি।
জানা যায়, একসময় ডাকিনীর পাটগ্রামে নিরাপদ পানির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। লোকজন বিভিন্ন পুকুর, খাল-ডোবার পানি ব্যবহার করত। শুকনা মৌসুমে পুকুর, ডোবা শুকিয়ে গেলে যেত হতো দূর জলাধারে। প্রজাদের এ দুর্ভোগ দেখে ভিতরবন্দের জমিদার প্রতিভা বালা চৌধুরী বিশ শতকের তৃতীয় দশকে ইঁদারাটি খনন করে দেন। পানি সমস্যার স্থায়ী সমাধান হওয়ায় ব্যাপক আনন্দ দেখা দেয় স্থানীয়দের মধ্যে। তারা দৈনন্দিন ঘর-গৃহস্থালি ছাড়াও বিয়েশাদি, বিভিন্ন পূজা-অর্চনায় ব্যবহার করত এর পানি। এ ছাড়া তৃষ্ণার্ত পথিকেরাও পান করত এর পানি। ইঁদারা পাড়ে, দলবেঁধে নারীরা আসতেন গোসল করতে। গোসল করার সময় তাঁরা সংসারের সুখ–দুঃখের গল্প করতেন একজন অন্যজনের সঙ্গে। ফলে তাঁদের মধ্যে সৃষ্টি হতো সখ্যতা, জড়াতেন ভালোবাসার বন্ধনে।
ইঁদারা পাড়ে বিকেল হলেই শুরু হতো খেলা। হাডুডু, ভলিবল, দাঁড়িয়াবান্ধাসহ নানা খেলা হতো এ মাঠে। বিশেষ করে হাডুডু খেলার মাঠ হিসেবে এটি ছিল পরিচিত। দিনের পর দিন চলত হাডুডু খেলা। স্থানীয়রা বিয়ে-অবিয়ে, চ্যাংড়া দল-বুড়া দল, উত্তর পাড়া -দক্ষিণ পাড়া, ব্যাপারী বাড়ি -সরকার বাড়ি ইত্যাদি নানা দলে বিভক্ত হয়ে খেলায় অংশ নিতেন। এ ছাড়া প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হতো ‘আয়না -চিরুনি’ কাপ হাডুডু টুর্নামেন্ট। গ্রামভিত্তিক দল গঠিত হয়ে এ টুর্নামেন্টে অংশ নিত। কোয়াটার এবং সেমিফাইনালে উঠা দলগুলো চাঁদা তুলে বাইরে থেকে খেলোয়াড় নিয়ে আসত। উত্তেজনাপূর্ণ এসব খেলায় দর্শকদের ছিল উপচে পড়া ভিড় । ফাইনালের দিন আনা হতো ব্যান্ডদল। খেলোয়াড়েরা বাদ্যের তালে তালে তাঁদের নৈপুণ্য প্রদর্শন করতেন। খেলায় যে দল জয়লাভ করত, তাদের দেওয়া হতো আয়না এবং পরাজিত দল পেত চিরুনি।
ইঁদারা পাড়ে, জোছনা রাতে প্রায়ই বসতো পুঁথি পাঠের আসর। গ্রামের ছোট–বড় সবাই আসত পুঁথি পাঠ শুনতে। শুনত হেঁটে যাওয়া পথিকেরাও। মাটিতে খড় বিছিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত শুনত পুঁথি পাঠ। পুঁথিগুলোর মধ্যে আমির হামজা জঙ্গে কারবালা, সোহরাব-রূস্তম, নিজাম উদ্দিন আউলিয়া, নবাব সিরাজ দৌলা, কালু গাজী, মালেক বাদশাহ, বাহারাম বাদশাহ, গহর বাদশাহ বানেছা পরী, বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের বাসরঘর, কমলা সুন্দরী ইত্যাদি ছিল সর্বাধিক শোতৃপ্রিয়।
এ ছাড়া প্রতিবছর চৈত্র-বৈশাখ মাসে গ্রামীণ মেলা বসত। আনন্দে মেতে উঠত পুরো গ্রাম। এ সময় মেয়েরা বাবার বাড়িতে নাইওর আসত। মিষ্টি হাতে উপস্থিত হতো নতুন আত্মীয়। মেলায় অনেক দোকানপাট আসত। ইঁদারা পাড়ের ছোট গণ্ডি পেরিয়ে মেলা ছড়িয়ে পড়ত আশপাশ পতিত জমিতেও । পাওয়া যেত মোয়া, মুড়কি, জিলাপি, বাতাসা, চিনির সাজ, নই, কদমাসহ মজাদার সব খাবার। বাচ্চাদের জন্য উঠত বাঁশি, চশমা, ঘড়ি, আলতা, চুড়িসহ বাঁশ ও কাঠের তৈরি হরেক খেলনা। বিনোদনের জন্য থাকত চরকি, নাগরদোলা, পুতুল নাচ ও বায়স্কোপ। এ ছাড়া হাঁড়িপাতিল, বাসনকোসন, দা, বঁটিসহ নানা তৈজসপত্রের দোকানও বসত। সকাল থেকে শুরু হওয়া এ মেলা চলত অনেক রাত পর্যন্ত।
ডাকিনীর পাটগ্রামের মো. জয়নাল আবেদীন (৫৭) বলেন, ‘ইঁন্দিরা পাড় ছিল আমাদের প্রিয় জায়গা। প্রতিদিন বিকেলে খেলতে যেতাম সেখানে। আমরা নিজেরাও যেমন খেলাধুলা করতাম, দেখতাম অনেকেরই খেলা। সব সময় একটা উৎসব মুখর ভাব ছিল সেখানে। আর সেটা ছিল ইঁন্দিরাকে কেন্দ্র করেই।’
স্মৃতিবিজড়িত এ ইঁদারার বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থা। এর কয়েক জায়গায় প্লাস্টার খসে পড়েছে। খুলে গেছে গাঁথুনির ইট। গায়ে জন্মেছে নানা রকম লতাপাতা ও আগাছা। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভয়ে উঁকি দেওয়ার সাহস পায় না অনেকেই। ইঁদারার গোড়ার শান উঠে পাশ ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে বাঁশঝাড়। এ ছাড়া দুই পাশের রাস্তা প্রশস্ত হওয়ায় কমে গেছে মাঠের আয়তন। বছরজুড়ে থাকে খড়ের পালা আর গরু বাঁধা। দেখে বোঝার উপায় নেই একসময় স্থানীয় জনসাধারণের কতটা জীবন ঘনিষ্ঠ ছিল এ ইঁদারা। এলাকাবাসীর দাবি, ঐতিহ্যপূর্ণ এ ইঁদারাটি সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
**নাগরিক সংবাদ-এ গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected]এ