অপেক্ষাই যখন ভরসা
যাপিত জীবনে খুশি হওয়া, আনন্দিত হতে পারাটা চরম সৌভাগ্যের।
সেদিন অফিসে ঢুকতেই এক সহকর্মী রাজ্যের উৎসাহ নিয়ে আমার ডেস্কে এসে জানাল তাঁর মেয়েটি কী একটা আর্ট কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়েছে। তৃপ্তি চোখেমুখে ঠিকড়ে বের হচ্ছে। সারা দিন অফিসে সবাইকে একই কথা বলতে দেখলাম। অন্য সবার কাছে মিষ্টি লাগলেও আমার লাগছে আদিক্ষেতা। আমার নিজের ওই বয়সী একটা ছেলে আছে। স্কুলে ফলাফলে বরাবরই টপার। দাবায় চ্যাম্পিয়ন। গেল মাসে স্কুল বিতর্কে সেরা বক্তার পুরস্কার পেয়েছে। ছেলের মা আরও কী সব, কত কিছুর কথা মাঝে মাঝে আমাকে বলে। আমি আগ্রহ পাই না। পৃথিবী যাদের পায়ের কাছে এসে জড়ো হয়ে আছে তা–ও খুশির কোনো কারণ দেখে না—এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়, তাদের ব্যাপার আলাদা। আমার সেই বালাই নেই। আমি চুনোপুঁটি মানুষ। তবু সান্ত্বনা এই যে এই দলে আমি একা নই। জীবন নিয়ে সুখী থাকার জন্য আনন্দ নিয়ে বাঁচার জন্য কত কিছুই না মানুষ করে।
ইদানীং কিছু মানুষ ফেসবুকে এসে টাকা দেখিয়ে বেড়ায়, এতে তারা কী মজা পায় জানি না। তবে বিষয়টা অদ্ভুত! অবশ্য অদ্ভুত কত কিছুই তো আমাদের দেখতে হয়, কীইবা থাকে করার। বাড়ির সামনের ওই যে নদীটা রাতের আঁধারে ভরাট করে দিচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যেই এখানে বিশাল বিশাল ইমারত উঠে যাবে। মাসখানেক আগেও এখানে শেয়ালের ডাক শুনেছি, এখন আর শুনি না। বিশাল বকের ঝাঁক এখানে সারা দিন চরে খেত। কিছুদিন ধরে দেখছি আর চরে না। দেখছি আমরা সবাই মিলে। দেখেই যাচ্ছি। অবাক লাগে না। পাশের বাসার পড়শি, যে কয়েক দিন আগেও দুটি বাচ্চা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে স্কুলে যেত। রাত নেই দিন নেই ভুঁড়ি কমানোর জন্য হাঁটতে বের হতো। আজ শুনলাম সে মারা গেছে। তা–ও মাসখানেক হয়েছে। অথচ আমি আজ শুনলাম। আমার অবাক লাগে না। আসলে অবাক হওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছি অনেক দিন আগেই। মানবজীবনে অবাক হওয়ার ক্ষমতা হারানো সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটা। আরেক সমস্যার নাম অতীত। অতীত মানুষ মনে রাখতে চায় না। শুধু দুঃখের অতীতই কষ্ট বাড়ায় না। সুখের স্মৃতিও কষ্ট বাড়ায়। মজার ব্যাপার হলো, চাইলেও মানুষ অতীত ভুলতে পারে না। নিজ দায়িত্বে হাজারো ব্যস্ততার ফাঁক গলে নিঃসঙ্গ মধ্যরাতে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। জ্ঞানত, অতীত নিয়েই জীবন কেটে যায় নিজের নিয়মে।
এই জীবন একটা ট্রেনের মতো। ট্রেনটা যখন বাধাহীন চলে...চলতে থাকে, তখন ছন্দময় কবিতার মতো লাগে। নিজের নিয়মে চলে, নিজের নিয়মে থামে। কারও প্রয়োজনে থামে না। নিয়মের বাইরে থামার নিয়ম নেই। হাজারো মানুষকে ফেলে চলে যায় নিজের গন্তব্যে।
ছোটবেলায় একটা সবুজ রঙের আইসক্রিম হাতে পেলেই ঈদের চাঁদ হাতে পেয়েছি লাগত। এখন তো চাঁদ নেমে হাতে চলে এলেও মনে হয় না খুশি লাগবে। অনুভূতিগুলো সব কেমন ভোঁতা হয়ে দলা পাকিয়ে থাকে। রং নেই, বৈচিত্র্য নেই, কৌতূহল নেই। সাদা–কালো জীবনে বেঁচে থাকার কোনো কারণও নেই। জানি এ থেকে নিস্তারও নেই। ভালো লাগে না রোগে ধরার আগে বৈচিত্র্যময় পৃথিবীটা কী দারুণ সব রঙের খেলা নিয়ে চোখে ভাসত। বর্ণময় সে সময় আবার কখনো ফিরে আসবে তেমন আশা করি না। স্রোতের টানে গা ভাসিয়ে দিয়ে তীর খুঁজতে নেই। এই স্রোত যেখানে নিয়ে যায় যাক। অপেক্ষা করছি। অপেক্ষায় সুখ নেই, স্বস্তিও নেই, তবে একটু ভরসা বোধ হয় থাকে।
লেখক: নুসরাত রহমান, কবি ও লেখক