নিজেকে মনে হয় প্রকৃতির মতোই সুন্দর

অলংকরণ: আরাফাত করিম

পাওয়া না–পাওয়ার হিসাব করে আমার কখনো মরে যেতে ইচ্ছে করেনি। আমার সব সময় মনে হয়েছে জীবন সুন্দর, অতিমাত্রায় সুন্দর। নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়নি কখনো বরং নিজেকে আমার প্রকৃতির মতোই সুন্দর মনে হয়। আমি নিজেকে বেশ ভালোবাসি এবং নিজের জন্যই বাঁচতে ইচ্ছে করে।

তবে হ্যাঁ, কখনো যে হতাশা ভর করে না বা ডিপ্রেসড হই না, তা বলব না। মাঝেমধ্যেই মনে হয় আমি তো এটা হতে পারতাম, ওটা হতে পারতাম বা ওই রকম হওয়া উচিত ছিল তখন একটু খারাপ লাগে। কিন্তু সেই খারাপ লাগাকে খুব একটা পাত্তা দিই না। কী পেলাম অথবা কী পেলাম না, এটা ভেবে সময় নস্ট করা বোকামি। তার চেয়ে ভালো কী পেয়েছি, এটা নিয়েই আনন্দে বাঁচা এবং ওপরওয়ালাকে ধন্যবাদ দেওয়া।
যখন খবরের কাগজে দেখি, কেউ আত্মহত্যা করেছে, শুধু হতাশা থেকে, তখন খুব খারাপ লাগে। মনে হয়, অনেক কষ্ট না পেলে কেউ জীবন থেকে পালায় না। আমরা এমন একটা সমাজে বেড়ে উঠি যেখানে মানুষের কাজই একে অন্যকে ছোট করা, অপমান করা, নেতিবাচক কথা বলা এবং অন্যের ভালোতে হিংসা করা। একটা উন্মুক্ত আকাশ আমাদের মাথার ওপর নেই যে আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আমরা বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারি।

লেখক
ছবি: সংগৃহীত

কোনো রকম হতাশাই আমাকে খুব বেশিক্ষণ চাপে রাখতে পারে না। তাহলে হয়তো বহুবার আত্মহত্যা করতে হতো। আমি আমার চারপাশের সুন্দর প্রকৃতি দেখি আর ভাবি, এতো সুন্দর জগত ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হবে কেনো। আমি তো এই অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতির জন্যই বেঁচে থাকতে পারি। আমার ফেলে আসা শৈশবের সোনালি দিনগুলোর কথা মনে হয়, আহ ছায়া সুনিবিড় শান্ত গ্রাম, মেঠোপথ, খোলা আকাশের নিচে দুরন্ত ছেলেবেলার বন্ধুদের নিয়ে মাঠময় দৌড়ে ঘুড়ি ওড়ানো, বৃষ্টিজল জমে থাকা বাড়ির ডোবায় কাগজের নৌকা ভাসানো, ভাইয়ের সঙ্গে ডাঙ্গুলি খেলা, মার্বেল খেলা, বাবার টানিয়ে দেওয়া জালে শীতের বিকেলে উঠোনে ব্যাডমিন্টন খেলা। এসব ভাবলে ভীষণ আবেগতাড়িত হয়ে যাই। ফিরে পেতে ইচ্ছে করে নিজের ছেলেবেলা। প্রাণভরে বাঁচতে ইচ্ছে করে।

এসব যেন আজও আমার হৃদয়ের পটভূমিতে আঁকা ছবি। সেই ছবি ছিন্ন করে জীবনটাকে নিয়ে পালিয়ে যাব এক অজানায়, এ তো নিজের সঙ্গেই একরকম ছলনা। এ জীবনের প্রতি এই প্রকৃতির প্রতি আমার একটা দায় রয়েছে। সে দায় তো আমাকে মেটাতে হবে। এতো আলো, এত রূপ–রস–গন্ধ নিলাম অথচ তাকে কিছু ফিরিয়ে না দিয়েই পালিয়ে যাব।

আমরা খুব স্বার্থপর শুধু নিতে জানি, কী করে দিতে হয়, তা জানি না। আমরা ভালোবাসার কাঙাল আমরা, ক্ষমতা লোভী আমরা, অর্থের জন্য মরিয়া। ভালো থাকা মানেই আমরা বুঝি কাঁড়িকাঁড়ি টাকা রোজগার করা দামী গাড়ি চড়া, পড়ালেখায় সবাইকে ডিঙিয়ে ক্লাসে প্রথম হওয়া মা–বাবা, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র আমাদের কাছে শুধু প্রত্যাশা করে। সেই পাহাড় সমান প্রত্যাশা যদি আপনি পূরণ করতে পারেন, তবেই আপনি সফল না হলে আপনি বাদ হয়ে যাওয়াদের তালিকায় লেখানো নাম। আপনাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না নামক এক তকমা।

আসুন আমরা ভালো থাকার, ভালো লাগার গল্প বলি। হেমন্তের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরের শিশিরে সবুজ ঘাসে কখনো পা ডুবিয়ে দেখেছেন, তাতে কি অনাবিল  প্রশান্তি, মধ্যদুপুরে শান্ত পুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকার যে শ্রান্তি, কিংবা কোনো কার্তিকের একলা বিকেলে ঝুলবারান্দায় বসে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দেওয়ার যে অনিন্দ্য সুখ, তা কি পাব সেই পালিয়ে যাওয়া জীবনে? কখনো কাউকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে দেখেছেন, তাতে কী প্রগাঢ় সুখ। কারও বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন কিংবা কারও মুখে হাসি ফুটিয়েছেন একবেলা অন্ন জুগিয়ে। এসব একটুখানি করে দেখুন, জীবনকে দামী মনে হবে। মনে হবে জীবন এত ছোট কেন, এক জীবনে কত কিছু করার বাকি।

আসলে গুণীজনেরা ঠিকই বলেন, জীবন অনেকটা বাঁশির মতো তাতে সুর নিজেকেই তুলতে হয়। নিজের জীবনকে নিজের মতো করে উপভোগ করতে জানতে হয়। কারও জন্য বা কারও কথায় মরে যাব, এটা ভীষণ বোকামি। তবে হ্যাঁ, একটা বয়স থাকে যখন মানুষ অল্পতেই ভেঙে পড়ে, মনে হয় কি লাভ এতো অপমানিত জীবন বয়ে বেড়ানোর। তারপর দেখবেন একটা সময় আসে, যখন মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে শিখে যায়। লড়াই করে বাঁচতে জানে। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে শেখে। তাই আমার মনে হয়, খুব ছোটবেলা থেকেই ছেলে–মেয়েকে বাস্তবতার ভেতর দিয়ে নিয়ে যেতে হয়, যাতে করে জীবনের সব ঝড়ঝঞ্ঝা সে শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে পারে।

আমার তো নিজের জন্য খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে। কেউ দুঃখ দিলো, আঘাত করল, অপমানিত হলাম অথবা কেউ হাতটা ছেড়ে শূন্যে ভাসিয়ে দিল, খুব স্বাভাবিক ভেঙে পড়া, বিপর্যস্ত হওয়া। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো, যে বা যাঁরা আপনাকে আঘাত দিলো তাঁরা যদি আপনাকে বুঝত, আপনার মতো বোধসম্পন্ন হতো, তাহলে তো আপনাকে কস্ট পেতে হতো না। কাজেই যারা আপনাকে বোঝেই না, সেই তাঁদের জন্য কেনো এত সুন্দর একটা জীবন জলাঞ্জলি দেবেন, বলুন তো।

সম্পর্ক অনেক রকম হয়। সম্পর্কের গভীরতাও হয় নানা রকম। দীর্ঘদিনের অভ্যস্ত একটা সম্পর্ক হতে হঠাৎ নিজেকে একা করে ফেলা ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক, অপমানেরও বটে। তাই বলে সেই অপমানের প্রতিশোধ নিতে হবে নিজেকে শেষ করে, এটা একদমই নির্বুদ্ধিতার কাজ।

জীবন অনেক সুন্দর। একার জীবনও অনেক সুন্দর। যদি আমরা সেটা ঠিকঠাক মতো যাপন করতে পারি।

একা থাকা মানুষকে অনেকেই খুব ডিপ্রেসড ভাবে। অধিকাংশ মানুষ একা সার্ভাইভ করা মানুষকে নেতিবাচক কথা বলে আর সে যদি হয় কোনো নারী, তাহলে তো কথাই নেই। অনেক নির্বোধ মানুষ মুখের ওপর বলে দেবে, আল্লাহ তুমি এখনো একা? তোমার কোনো সমস্যা হয় না? অথবা কী করে সামলাও নিজেকে?

কী অবান্তর সব প্রশ্ন। যে মানুষটা একা, সে তো একাই সব সামলাবে, এটাই স্বাভাবিক। কাউকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বার বার তার সমস্যার কথা মনে করিয়ে দিলেই কি সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে?

আসলে আমাদের সমাজে নেতিবাচক কথা বলার নেতিবাচক চিন্তা করার লোকের অভাব নেই। অথচ এই মানুষগুলোই আপনার একটা ভালো খবরে মন খারাপ করবে। আর আপনার খারাপ সময়ে মমতার ঝুলি নিয়ে আসবে আহা–উহু করতে, সে মমতায় মায়ার চেয়ে কাঁটাই থাকবে বেশি কিন্তু সতীর্থ হয়ে পাশে দাঁড়াবে না। এসব মন্দের বন্ধুদের কথায় মন খারাপ না করে নিজের শিরদাঁড়া সোজা করে সমাজে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় জয়।

সত্যি বলতে আমরা অন্যর বা বাইরের মানুষের কথায় যতটা না কষ্ট পাই, তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট পাই কাছের মানুষের কথায়। যতটা জানি, অন্যের কথায় আঘাত পেয়ে কেউ আজও সুইসাইড করেনি, শুধু আপনজন এবং কাছের মানুষের কারণেই মানুষ এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়।

অনেক সময় মা-বাবা এবং পরিবারের লোকজন এতো বেশি প্রত্যাশা করবে সন্তানের কাছে যে কথায় কথায় অন্যের সঙ্গে তুলনা করবে, কেনো পড়ালেখায় অন্যদের মতো মেধাবী না, কেনো অনেক ভালো চাকরি করে না, কেনো অন্যদের মতো বিয়েশাদি করে সংসারি হচ্ছে না, এ রকম অগণিত নেতিবাচক কথা আপনাকে হজম করতে হবে। খুব কম  মা–বাবাই বোধ হয় বলেন, তুমি যা হয়েছো, আমরা তাতেই খুশি। এ রকম একটা আশাব্যঞ্জক কথা আপনাকে যে কতটা দূর নিয়ে যেতে পারে, তা আমরা আসলে উপলব্ধিই করি না।

কত রকমভাবে যে আপনাকে দোষারোপ করা হবে, হেনস্তা করা হবে, তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। এরা এমন কিছু কথা আপনাকে বলবে যে আপনার তখন সত্যি সত্যি মরে যেতে ইচ্ছে করবে। হয়তো যাঁরা একদমই সহ্য করতে পারেন না, তাঁরা মরেও যান। কিন্তু তাতে কার কি যায়–আসে, বলুন তো?

কিছুদিন পরিবারের লোকজন আহাজারি করবে, কান্নাকাটি করবে, তারপর যার যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে। এটাই জাগতিক নিয়ম। জীবন বহমান নদীর মতো, কারও জন্যই সে অপেক্ষা করে না। শুধু বোকার মতো থাকবে না স্বেচ্ছায় চলে যাওয়া মানুষটি।

আমার খুব পছন্দের একটা গান আছে—
‘দেখো আলোয় আলো আকাশ
দেখো আকাশ আলোয় ভরা
এত আনন্দ আয়োজন সবই বৃথা আমায় ছাড়া।’

কিন্তু না, মোটেও কিছু বৃথা নয়। সমস্ত আনন্দ আয়োজনই যথারীতি আপনাকে ছাড়া পালন হবে। তাহলে কেনো আমি অন্যদের ওপর অভিমান করে আমার সুন্দর জীবনটা মৃত্যুর কাছে সমর্পন করব, বলুন তো।

জীবন সব সময় উত্থান–পতনের ভেতর দিয়েই যায়। কারও জীবনই খুব একটা সহজ পথে চলে না। লড়াই করেই সবাইকে বাঁচতে হয়। এটাই জীবনের নিয়ম। যে জীবনে ভাঙা–গড়া নেই, সে জীবনে প্রাপ্তির আনন্দ বড় পানসে।

আসলে বাঁচার জন্য খুব বেশি কিছু লাগে না। মানুষের তো চাওয়ার কোনো শেষ নেই। যার জীবনে চাওয়া যত কম, তার স্বস্তি তত বেশি। অল্পতেই যে খুশি হতে পারে, তার জীবনে দুঃখ এসে ভর করতে পারে না। যে নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করে না, সেই আসলে প্রকৃত সুখী।

মানুষ চাইলেই ভালো থাকতে পারে কথাটা হয়তো সব সময় সত্যি নয়, কিন্তু মন্দ থেকে লাভ কী বলুন।

প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার নামই জীবন। অনেক নেতিবাচক মানুষ আমাদের চারপাশে আছে, যারা আপনাকে সামনে এগোতে নিরুৎসাহিত করবে, আপনার কাজ নিয়ে সমালোচনা করবে, আপনি কোথায়, কার সঙ্গে যাচ্ছেন, এসব নিয়েও মন্দ কথা বলবে। একদম পিছপা হবেন না।

দ্বিধাদ্বন্দ্বে না ভুগে ঠিক নিজের মতো করে বাঁচুন। করব কি করব না, হবে কি হবে না, লোকে কি বলবে—এই ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। দোদুল্যমান অবস্থায় থেকে কখনো ভালো কিছু করা যায় না।

নিজের ভেতর হতাশা আসতেই দেবেন না। আশাবাদী হোন, মনকে দৃঢ় রাখুন। এমন কিছু করুন, যা দেখে লোকে আপনাকে সম্মান করবে, আপনার মতো হতে চাইবে। সে হতে পারে আপনার কর্ম, আপনার ব্যক্তিত্ব, আপনার সাজপোশাক, আপনার কথা বলার ধরন অথবা আপনার মানবিকতা।

  • রোজিনা রাখী, ফিচার লেখক