‘নীল অর্থনীতি’ নিয়ে পরিকল্পনার হাল কি

ছবি: রয়টার্স

নীল অর্থনীতি হচ্ছে সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতি। অর্থাৎ সমুদ্রে অবস্থিত বিশাল জলরাশি এবং এর তলদেশের বিশাল সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন। ব্লু-ইকোনমি বা নীল অর্থনীতি শব্দটি  হয়তো এখন অনেকের কাছে অপরিচিত মনে হতে পারে। কিন্তু এ অপরিচিত শব্দটিই ভবিষ্যতে প্রায় সবার কাছেই নিত্যদিনের সাধারণ শব্দ হয়ে উঠতে পারে, যদি আমরা এর সম্ভাবনাকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগাতে পারি।

আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন ১৯৮২–এর অধীনে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় অনুযায়ী, বাংলাদেশ সমুদ্রপৃষ্ঠে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমতুল্য এলাকা এবং সমুদ্রের তলদেশে সব প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর একচ্ছত্র অধিকার অর্জন করেছে। আমাদের এ সমুদ্র–সম্পদ প্রযুক্তি এবং জ্ঞানের অভাবে অধিকাংশই অব্যবহৃত রয়ে গেছে। নীল অর্থনীতির ধারণাটি আন্তর্জাতিকভাবে যতটা আলোচিত বাংলাদেশে ততটা নয়। এর কারণ হিসেবে বলা যায় দেশে এ বিষয়ে গবেষণার অভাব। কিন্তু বাংলাদেশে এ অর্থনীতির অনেক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র রয়েছে, যা দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হবে।

বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ সমুদ্র দিয়ে বহন করা হয় এবং বন্দরগুলো দ্বারা পরিচালিত হয়। শিপিং একটি বৃহত্তর পরিবহনব্যবস্থা যেখানে দুর্ঘটনার হার, সন্ত্রাসবাদী ঘটনা অনেকটাই কম এবং পরিবেশগত দিক দিয়েও নিরাপদ।
প্রাকৃতিক মৎস্য আহরণের মাধ্যমে ৪৩০ কোটি মানুষের প্রোটিনের চাহিদা মেটানো সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের মতে, কমপক্ষে ৫০০ প্রজাতির মাছই আছে সমুদ্রে এ ছাড়া শামুক, ঝিনুক, অক্টোপাস, কাঁকড়া, হাঙ্গরসহ হাজারো অর্থকরী প্রাণী তো রয়েছেই, যা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারে।

চলতি মৌসুমে কক্সবাজার জেলায় রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদিত হয়েছে। পরিমাণে তা ১৮ লাখ ২০০ মেট্রিক টন, যা গত ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

সমুদ্রের জলে কৃত্রিম আবদ্ধ পুকুর সৃষ্টি করে চিংড়ি মাছ, ফিনফিস, সেলফিস, খাদ্য তৈরির শেওলা জাতীয় উদ্ভিদ, মুক্তার জন্য ঝিনুক চাষ, মানুষের ও পশুর জন্য খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানির জন্য আগাছা চাষ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচুর আয় সম্ভব।

চট্টগ্রাম বন্দর
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

সমুদ্র হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদের খনি। সমুদের তলদেশে রয়েছে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক  গ্যাস। আমাদের সমুদ্রের ২৮টি ব্লকের মধ্যে দুটি ব্লকে বহুজাতিক কোম্পানি কনকোফোলিস প্রায় পাঁচ টিসিএফ গ্যাস পেয়েছে। এ সম্পদ ছাড়াও আছে মূল্যবান বালু, থোরিয়াম ও ইউরেনিয়ামের মতো অতি মূল্যবান ধাতু যাতে মিশে অছে ম্যাগনেটাইট, জিরকন, রুটাইল, ইলমোনাইটের মতো মূল্যবান আকরিক। যার বৈদেশিক মূল্য কোটি কোটি ডলার।

কক্সবাজার বাংলাদেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত হিসেবে বিবেচিত। সেখানে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র সেন্টমার্টিন দ্বীপ। এ প্রবাল দ্বীপটি বাংলাদেশের স্থানীয় এবং বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় অবকাশকেন্দ্র। এ ছাড়া কুয়াকাটা সৈকত থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায় বলে এ সৈকতের প্রতি বিশেষ এক আকর্ষণ রয়েছে।

চলতি মৌসুমে কক্সবাজার জেলায় রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদিত হয়েছে। পরিমাণে তা ১৮ লাখ ২০০ মেট্রিক টন, যা গত ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

সামুদ্রিক ঢেউ, স্রোত ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়ে থাকে। সমুদ্র তীরে বা অগভীর সমুদ্রে সোলার প্যানেল স্থাপন করে বা বাতাস কল ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন হয়ে থাকে, যা পরিবেশের কোনো ক্ষতি সাধন করে না।

জিন  প্রযুক্তি, মেডিকেল, কৃষি পরীক্ষাগারে জীন প্রযুক্তিতে এর ব্যবহার অনেক ফলপ্রসূ হতে পারে।

বাংলাদেশ জাহাজ নির্মাণে বিশ্বে ১৩তম আর শিপ ব্রেকিং–ও তৃতীয়। এ এক বিরল সম্মান। এ শিল্পে ব্লু–ইকোনোমির ছোঁয়ায় বাংলাদেশ এক দিন ডার্বি, ইয়র্কশায়ার, গ্লাসগোর জাহাজগুলোর মানকে ছড়িয়ে যাবে। আগামী এক দশকে জাহাজ নির্মাণশিল্প বাংলাদেশে আরও বিকশিত হবে। সমুদ্র–সংশ্লিষ্ট পর্যটনশিল্প আরও ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়। এ ছাড়া ঝিনুক, সামুদ্রিক মুক্তাসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক সম্পদ সংশ্লিষ্ট ব্যবসাও সামনে বৃদ্ধি পাবে বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন [টুওয়ার্ড আ ব্লু–ইকোনমি, বিশ্বব্যাংক প্রকাশনা, মে ২০১৮]।

আমাদের নীল অর্থনীতির চাকা এখনো মন্থর গতিতে চলছে, যার কারণ হিসেবে বলা যায়, সমুদ্রবিজ্ঞানে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব, গবেষণার সুযোগের অভাব, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব। সুতরাং এর জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আবশ্যক। আমাদের ব্লু–ইকোনমিতে হাত দেওয়ার আগে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে—
* সঠিক ডাটাবেজ ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান,
* সমুদ্র সম্পদের পরিমাণ,
* সম্পদের প্রকৃত বাজার যাচাই,
* প্রয়োজনীয় আধুনিক অবকাঠামো,
* দক্ষ জনশক্তি,
* সঠিক কর্মপরিকল্পনা,
* সম্পদ অনুসন্ধান টিম গঠন,
* সচল ইকোসিস্টেম মিথস্ক্রিয়ার নিশ্চয়তা,
* মেরিন রিসোর্সভিত্তিক গবেষণা,
* পরিবেশবান্ধব ও টেকসই নীতিমালা।

এসডিজির ১৪ নম্বর ধারায় টেকসই উন্নয়নের জন্য সামুদ্রিক সম্পদের অনুসন্ধান ও এর যথাযথ সংরক্ষণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির এ লক্ষ্য পূরণে তাই ব্লু–ইকোনমিকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এখন এ সম্ভাবনাকে সাফল্যে পরিণত করতে সরকারকে আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বাজেট প্রণয়ন করতে হবে, প্রশিক্ষণ এবং গবেষণার জন্য, বাংলাদেশের দক্ষ শ্রমিকদের বিদেশ থেকে ফেরত আনতে হবে যাতে তারা নিজ দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।

এক কথায় ব্লু–ইকোনমিকে বলা যায়, ‘A complete natural system for economical revolution’ কিন্তু এ সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ সামুদ্রিক ও পরিবেশের ক্ষতি না করে সম্পদের সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবহার এবং এমনভাবে আহরণ করা যাতে দূষণ ও অতিমাত্রা আহরণের ফলে সম্পদ নিশেষ হয়ে না যায়। এ বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারকে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতিতে বিপ্লব আনতে হলে, শুধু পরিকল্পনা করলেই চলবে না, তার বাস্তবায়নও প্রয়োজন। যেন এ অপার সম্ভাবনা শুধু একটি সম্ভাবনা হয়েই রয়ে না যায়।

লেখক: দীপিকা পাল, শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ