ভুলো না আমায়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘Time you old Gypsy man,
Will you not stay,
Put up your caravan
Just for one day..’
(Time, you old Gypsy man—রালফ হডসন)

আব্বার উদাত্ত কণ্ঠের আবৃত্তি ইমনের মতো চঞ্চল মানুষকেও থমকে দেয়। আব্বা আমাদের বোঝান, সময় বুড়ো যাযাবরের চেয়েও চঞ্চল। সে থেমে থাকে না, অনেক শহর ঘুরে বেড়ায়, অনেক উত্থান-পতন দেখে। ইন্টারমিডিয়েটে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি কলেজে ভর্তির পরপরই ‘ফাস্ট ইয়ার ডোন্ট কেয়ার’ ভাবটা জেঁকে বসেছে। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র বাংলা-ইংরেজিতে দুর্বল—এটা হাসিমুখে মেনে নিয়েই পাবলিক লাইব্রেরি-ফুলার রোডের ব্রিটিশ কাউন্সিলে ঘুরে বেড়াই। বিকেলে মহসিন হলের মাঠে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের প্র্যাকটিসে এমেকা, নালজেগার, নাসের হেজাজি, কায়সার হামিদদের প্র্যাকটিস সরাসরি দেখতে যাই। কী সে উত্তেজনা!
কিন্তু চঞ্চল সময় তো থেমে থাকে না—সেকেন্ড ইয়ার ওঠার পরীক্ষা চলে আসে।

ইমনও ঘাড়ে নিশ্বাস ছাড়ছে ঢাকা কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়ে। আমি ইংরেজির কঠিন কঠিন গদ্য-পদ্য নিয়ে খাবি খাচ্ছি। আব্বা বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘সাহস হারাবে না, আমি তো আছি।’ প্রশাসক পরিচয় ছাপিয়ে বের হয়ে আসে ‘হাজী আসমত কলেজ, ভৈরব’ এবং ‘আবুজর গিফারী কলেজ, মালিবাগ’-এর দয়ালু ছাত্র–অন্তঃপ্রাণ একজন শিক্ষক। ডায়েরি বের করে একটির পর একটি কবিতার সমাধান দেন গল্পের মতো করে।

আব্বা আমাদের বোঝান, ক্ষণস্থায়ী সুন্দর ড্যাফোডিল ফুলের মতোই ক্ষণজন্মা মানুষের জীবন। মানুষের ও নিজেদের কল্যাণের জন্য ড্যাফোডিল ফুলের মতোই হাসিমুখে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে—
‘Like to the summer's rain;    
Or as the pearls of morning's dew ,
 
Never to be found again. '  
     
(To Daffodils-Robert Herrich)

গ্রীষ্মের বৃষ্টি আর মুক্তার মতো সকালের শিশির কখনো আর ফেরত আসবে না।
ইমনকে নিয়ে আম্মার চিন্তার শেষ নেই। কয় দিন থেকে জীবন্ত বেড়া ‘ঢোলকলমি’ পোকার বিষক্রিয়ায়, ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, সাপ্তাহিক বিচিত্রায় একের পর এক মৃত্যুর সংবাদ দেখে আম্মা দিশাহারা। সারা দেশে ঢোলকলমির মতো উপকারী গুল্মের নিধনের বিরুদ্ধে পরিবেশবাদী আর জীববিজ্ঞানীরা সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। হুজুগে বাঙালি কোনো এক কৃষককে ঢোলকলমির ঝোপে সাপের কামড়ে মরতে দেখে এই উপকারী বন্যাসহনীয় বেড়ালতার ওপর হামলে পড়ে। ইমনের ওপর মাঠে খেলতে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা দেন আম্মা। কিন্তু ম্যারাডোনার মতো ইমনও দুরন্ত। হঠাৎ ঢাকা কলেজের বড় পরিসরে এসে উড়ন্ত পাখির মতো বাধাহীন হয়ে যায়। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে বাসায় আসতেও অনীহা; বাঁধন, সন্ধানী, রেড ক্রিসেন্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
১৯৮৮ সালের প্রলয়ংকরী বন্যায় দেশের ৬০ শতাংশ এলাকা ডুবে যায়। আগস্ট-সেপ্টেম্বরজুড়ে এই বন্যা বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সারা দিন প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেবের ‘তোমাদের পাশে এসে/ বিপদের সাথি হতে/ আজকের চেষ্টা আমার’—গানটি বাজতেই থাকে।
এর মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-সাংস্কৃতিক কর্মীদের আহ্বান—
       ‘ওগো পুরবাসী,
আমি দ্বারে দাঁড়ায়ে আছি উপবাসী’
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ওগো পুরবাসী)
—নগরবাসীর মনে ব্যাপক দয়ার সৃষ্টি করে। ইমন আম্মাকে উদ্বুদ্ধ করে বাসায় নাশতার বাইরে দ্বিগুণ পরিমাণ রুটি তৈরি করতে। তাঁদের বন্ধুরা বাড়ি বাড়ি রুটি সংগ্রহ করে ঢাকার নিচু এলাকাগুলোয় বন্যার্তদের পৌঁছে দেওয়া শুরু করে।

প্রতিটি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া। হায়! পানির মধ্যে থেকে পানিকেই বিষবৎ মনে করে বন্যার্তরা। আব্বা আমাদের বুঝিয়ে দেন, স্যামুয়েল ট্যায়লর কলরিজের ‘Rime of Ancient mariner’—এর বিখ্যাত উক্তি—
‘water water everywhere
nor any drop to drink।’
প্রাচুর্য থাকলেও ন্যূনতম চাহিদা না মিটলে মানুষের কি কষ্ট!
উজ্জ্বল ঝকঝকে চোখের ইমনকে কয় দিন মনমরা দেখে আব্বা জিজ্ঞাসা করেন, ‘বাবু, তোমার মন কি খারাপ?’ সব সময় স্ফূর্তিতে থাকা ইমন মানুষের নিচুতায় কষ্ট পেয়ে বলে,  ‘মানুষের এত কষ্ট; তারপরও কিছু মানুষ কেন বন্যার্তদের জন্য দেওয়া ত্রাণ, টাকা নিজেরা নিয়ে নেয়?’ আব্বা আমাদের বইয়ের কবিতা আওড়িয়ে বলেন—
‘Man is unjust, But God is  just;
and finally justice triumphs’
(হেনরি ওয়াডসওয়ার্থ লংফেলো—Evangeline: A Tale of Acadie)
মানুষ ভুল করতে পারে, কিন্তু সৃষ্টিকর্তা কখনো ভুল করেন না; সময় শেষে ন্যায়বিচারই বিজয়ী হয়।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

গড়পড়তা কলেজছাত্রদের তুলনায় আমরা কিছুটা ছোট হওয়ায় মনে যেন ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স না গড়ে ওঠে, এ জন্য সব সময় আব্বা-আম্মা উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলতেন। পাঠ্যবইয়ের রাউলিংসয়ের ‘A Mother in Mannville’–এর ছোট্ট এতিম ছেলে জেরির ‘size does not matter’ উক্তিটি আব্বা প্রায়ই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতেন। ১২ বছরের ছোট্ট এতিম জেরি তাঁর সাহস, সরলতা আর একাগ্রতা নিয়ে এগিয়ে যায়।

আব্বা শুধু পড়া মুখস্থ করতেই বলতেন না, সেই সঙ্গে জীবন চলার পথে হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কার কথাও বলতেন। সব সময় আওড়াতেন, ‘Hope for the best and prepare for the worst’—ভালোর জন্য আশা করবে আর সবচেয়ে খারাপের জন্য তৈরি থাকবে। কারণ, উনি জানতেন রবার্ট ব্রাউনিংয়ের ‘The Patriot’–এর ‘Thus I entered and thus I go.’-এর মতোই জীবনে উত্থান-পতন আছে। যতক্ষণ মানুষকে দিতে পারবে, ততক্ষণ নায়ক; যখন দিতে পারবে না, তখনই প্রতিনায়ক।

*লেখক: আসফাক বীন রহমান, সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস: [email protected]