কর কমানোর বুদ্ধিদীপ্ত উপায়: কর রেয়াত

আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী বিনিয়োগ ও ব্যয়ের মাধ্যমে কর রেয়াতের সুযোগ থাকলেও সচেতনতার অভাবে বহু করদাতা এখনো এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেকে এখনো জানেন না কর রেয়াত আসলে কী, কোন খাতে বিনিয়োগ করলে এই সুবিধা পাওয়া যায়, কিংবা সর্বোচ্চ কত টাকা পর্যন্ত কর রেয়াত গ্রহণ করা সম্ভব। অথচ আয়কর আইন ২০২৩–এ নির্ধারিত নিয়মগুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকলে একজন করদাতা বৈধভাবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ করছাড়ের সুবিধা নিতে পারেন। ফলে ব্যক্তিগত আর্থিক পরিকল্পনায় কর রেয়াতের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

কর রেয়াত বা ট্যাক্স রিবেট হলো এমন একধরনের সুবিধা, যার মাধ্যমে করদাতারা তাদের মোট করযোগ্য আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ বিনিয়োগ বা ব্যয় করলে করছাড় পান। সরকার নাগরিকদের সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই রেয়াত প্রদান করে থাকে।

কর রেয়াত কর ফাঁকি নয়, এটি আপনার প্রাপ্য পুরস্কার।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কর রেয়াত শুধু করদাতাদের আর্থিক চাপ কমায় না, বরং সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করে তোলে। এ জন্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন—প্রত্যেক করদাতার উচিত আয়কর আইন–২০২৩ অনুযায়ী কর রেয়াতের নিয়ম ভালোভাবে জেনে যথাযথভাবে রিটার্ন দাখিল করা।

কর রেয়াতযোগ্য বিনিয়োগের পরিমাণ

আয়কর আইন–২০২৩–এর ধারা ৭৮–এর বিধান সাপেক্ষে এবং ষষ্ঠ তফসিলের অংশ ৩–এ নির্ধারিত সীমা, শর্তাবলি এবং যোগ্যতা সাপেক্ষে কোনো বিনিয়োগ করা হইলে, কোনো করবর্ষে মোট আয়ের উপর প্রযোজ্য কর হইতে নিবাসী স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতা ও অনিবাসী বাংলাদেশি স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতা নিম্নবর্ণিতভাবে কর রেয়াত প্রাপ্য হইবেন—

(ক) ০.০৩ ‘ক’; বা (খ) ০.১৫ × ‘খ’; বা (গ) ১০ (দশ) লক্ষ টাকা, এই তিনটির মধ্যে যাহা কম, এই ক্ষেত্রে ‘ক’ = কর অব্যাহতি প্রাপ্ত আয়, হ্রাসকৃত করহার প্রযোজ্য এইরূপ আয় , [অংশীদারি ফার্ম বা ব্যক্তিসংঘ হইতে প্রাপ্ত শেয়ার আয় এবং চূড়ান্ত করদায়] প্রযোজ্য এইরূপ আয় বাদ দিয়া পরিগণিত মোট আয়, এবং ‘খ’ = কোনো আয়বর্ষে ষষ্ঠ তফসিলের অংশ ৩ অনুসারে করদাতার মোট বিনিয়োগ ও ব্যয়ের পরিমাণ।

মনে রাখা দরকার, আয়কর আইন–২০২৩–এর ধারা ৭৮–এর পূর্ববর্তী বিধান অনুযায়ী কর রেয়াত নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মোট আয় পরিগণনার সময় কর অব্যাহতি প্রাপ্ত আয়, হ্রাসকৃত করহার প্রযোজ্য এবং ন্যূনতম কর প্রযোজ্য এরূপ আয় বাদ দেওয়া হতো। অর্থ অধ্যাদেশ ২০২৫–এর মাধ্যমে আনীত সংশোধনীর মাধ্যমে ন্যূনতম কর প্রযোজ্য এরূপ আয়কে কর রেয়াতযোগ্য মোট আয় পরিগণনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং অংশীদারি ফার্ম বা ব্যক্তিসংঘ হইতে প্রাপ্ত শেয়ার আয় এবং চূড়ান্ত করদায় প্রযোজ্য এইরূপ আয় কর রেয়াতযোগ্য মোট আয় পরিগণনার সময় বাদ দেওয়ার বিধান করা হয়েছে।

নাগরিক সংবাদ-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

যে খাতগুলোতে বিনিয়োগ করলে কর রেয়াত পাওয়া যায়

সরকার নাগরিকদের সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে উৎসাহ দিতে কর রেয়াতের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত করেছে। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, নিচের খাতগুলোতে বিনিয়োগ করলে কর রেয়াত পাওয়া যায়:

  • জীবনবিমা ও ডিফার্ড অ্যানুইটি পরিকল্পনা

  • প্রভিডেন্ট বা সুপারঅ্যানুয়েশন ফান্ড

  • অনুমোদিত পেনশন স্কিম

  • সরকারি সিকিউরিটিজ ও মিউচুয়াল ফান্ড

  • ডিপোজিট পেনশন স্কিম (ডিপিএস) বা মাসিক সঞ্চয় স্কিম (এমএসএস)

  • তালিকাভুক্ত শেয়ার, এক্সচেঞ্জ-ট্রেডেড ফান্ড (ইটিএফ) এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) বা ব্যাংক পরিচালিত ইউনিট ফান্ড

জীবন বিমা বা অ্যানুইটি পলিসি নিজের, স্বামী/স্ত্রী বা অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের নামে থাকলে প্রিমিয়ামের ১০% পর্যন্ত রেয়াত পাওয়া যায়। হিন্দু অবিভক্ত পরিবারের ক্ষেত্রে, যদি পলিসির প্রিমিয়াম বাংলাদেশে পরিশোধ করা হয় এবং তা কোনো পুরুষ সদস্য বা তাঁর স্ত্রীর নামে হয়, তাহলে রেয়াত প্রযোজ্য হবে।

কোনো কর্মচারীর বেতনের কাঠামোতে যদি ডিফার্ড অ্যানুইটি বা পরিবারের সুরক্ষার পলিসি থাকে, তবে তিনি বার্ষিক বেতনের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত রেয়াত পেতে পারেন। প্রভিডেন্ট ফান্ড, ফিউচার ফান্ড এবং অনুমোদিত পেনশন ফান্ডে অবদান রাখলেও নির্ধারিত সীমার মধ্যে রেয়াত পাওয়া যায়।

সরকারি সিকিউরিটিজে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত, ব্যাংক বা আইসিবি পরিচালিত মিউচুয়াল ফান্ড, ইউনিট সার্টিফিকেট বা ইটিএফে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে রেয়াত প্রযোজ্য। ব্যাংক পরিচালিত ডিপিএস বা এমএসএস অ্যাকাউন্টে সর্বোচ্চ ১.২ লাখ টাকা পর্যন্ত রেয়াত পাওয়া যায়। নতুন তালিকাভুক্ত শেয়ার বা সিকিউরিটিজে বিনিয়োগেও একই সুবিধা প্রযোজ্য, তবে এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের কোনো সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি।

শুধু ব্যক্তিগত বিনিয়োগ নয়—অনুমোদিত দাতব্য হাসপাতাল (যেগুলো বড় শহরের বাইরে অন্তত এক বছর ধরে কার্যকর), প্রতিবন্ধী সহায়তা সংস্থা, অনুমোদিত শিক্ষা বা কল্যাণ প্রতিষ্ঠান, জাকাত ফান্ড, বোর্ড অনুমোদিত কল্যাণ বা যৌথ বিমা স্কিম এবং মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিবাহী জাতীয় প্রতিষ্ঠানে দান করলেও রেয়াত পাওয়া যায়।

কেন কর রেয়াত গুরুত্বপূর্ণ

কর দেওয়া আনন্দের নয়, কিন্তু বুদ্ধিমানের মতো কর দেওয়া বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ। কর রেয়াত, কোনো কর ফাঁকি নয়—এটি সঞ্চয় ও বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়ার সরকারের বৈধ প্রণোদনা। আপনি যখন নিজের ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করেন, সরকারও আপনাকে পুরস্কৃত করে। ফলাফল, আপনি আর্থিকভাবে সুরক্ষিত হন, আর অর্থনীতি পায় নতুন গতি।

আর্থিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন ‘ডোন্ট জাস্ট ফাইল—প্ল্যান’ অর্থাৎ, শুধু ট্যাক্স রিটার্ন জমা না দিয়ে আগে থেকেই পরিকল্পনা করুন কোথায় বিনিয়োগ করলে আপনি সর্বাধিক কর রেয়াতের সুবিধা পাবেন। আয়কর আইন ২০২৩ করদাতাদের সামনে খুলে দিয়েছে এক সোনালি সুযোগ, একই সঙ্গে কর সাশ্রয়, বিনিয়োগ ও জাতীয় উন্নয়নে অংশগ্রহণের।

আপনি যখন সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করেন, তখন আপনার প্রতিটি টাকা হয়ে ওঠে উন্নয়নের অংশীদার। ট্যাক্স রিবেট বা কর রেয়াত, শুধু কর বাঁচানোর কৌশল নয়—এটি আর্থিক সচেতনতার এক চিহ্ন, দায়িত্বশীল নাগরিকত্বের প্রকাশ। একটু হিসাব-নিকাশ, কিছু পরিকল্পিত বিনিয়োগ, আর আপনি সহজেই পেতে পারেন লাখ টাকার করছাড়, নিজের নিরাপত্তা, আর দেশের অর্থনৈতিক শক্তির অংশীদারত্ব।

লেখক: ফয়সাল ইসলাম এফসিএ, আর্থিক খাতের বিশ্লেষক