ফিরে দেখা ’৭৯-এর কক্সবাজার
১৯৭৯ সালে আমার প্রথম বিমানে আরোহণ, কক্সবাজার ও সমুদ্রদর্শন, বাংলাদেশ বিমানে চাকরির বদৌলতে। ১৯৭৯-এর জানুয়ারিতে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে কাজে যোগ দেওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যে কর্তৃপক্ষ আমায় বদলি করে কক্সবাজার বিমানবন্দরে, তথা আমায় দিয়ে দিল যেন বঙ্গোপসাগরের ইজারা-মালিকানাও কি?
সেই আমি ‘সমুদ্র’-এর মালিক হলাম ১৯৭৯ সালে। এটি প্রথমবার, দেড় বছর আপ্রাণ, অন্তরে-বাইরে উপভোগ করলাম কক্সবাজারের সাগর, মৎস্য শিকার, বালুকা বেলায় লাল কাঁকড়ার সঙ্গে লুকোচুরি খেলা, ঝিনুক কুড়ানো, শান্তির প্রতীক ঝাউবনে বেড়ানো, বনভোজন, কক্সবাজারের বিচিত্র ভাষা রপ্ত করা, রুপচাঁদাভাজি, মহেশখালী, হিমছড়ি, সাগরতীরের পাহাড়ে ননীদার সঙ্গে হরিণ শিকারে গিয়ে কান্নাকাটি, হাতির খপ্পরে পড়ার আশঙ্কায় ভীতি, রাডার স্টেশনে গিয়ে, খোলা ছাদে সাগর বিধৌত দক্ষিণার কোলাকুলি উপভোগ! প্রায় প্রতিদিন সকালে সমুদ্রের সঙ্গে কোলাকুলি, ঢেউগুলোর সঙ্গেও যেন আমার প্রাণের বন্ধুত্ব, রাতে সাগরের ঢেউয়ের শোঁ শোঁ শব্দের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘুমের রাজ্যে চলে যাওয়া, ভোরে আবার ঢেউগুলোর আহ্বানেই চোখ মেলেই কয়েকজন মিলে সাগরপানে দৌড়।
সারা দিনে ঘণ্টা তিনেকের কাজ, ছোট্ট উড়োজাহাজ ৪৪ সিটের Fokker-27-friendship। তা-ও আবার ’৭৯-এর প্রথমভাগে এক দিন পরপর একটা ফ্লাইট। পরে অবশ্য প্রতিদিন ছিল,...অশান্ত অবসর। আজ ঝাউবনে তো কাল পাহাড়ে, পরশু রামুর বৌদ্ধবিহারে, পরদিন টেকনাফ, তার পরদিন রাবারবাগান, এরপর দিন মহেশখালীতে ভাটার কারণে নৌকা আটকে কয়েক ঘণ্টার বিরতি, আরেক দিন অন্য কোথাও....কী বিচিত্র অভিজ্ঞতা!
ফ্লাইটের দিন ছাড়া কোনো কাজ নেই আমাদের (যাঁরা বিমানবন্দরে কাজ করতাম)। সেই যে সমুদ্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো, এরপর আবার ’৯২-তে কক্সবাজার বদলি, প্রায় দুই বছরের আবার কক্সবাজারের জীবন, তবে অবশ্যই ভিন্ন আবহ, পটভূমি। তত দিনে কক্সবাজার অনেক পাল্টে গেছে। অনেকে বলবেন, উন্নতি হয়েছে। আমার কাছে মনে হতো, কক্সবাজারকে প্রাকৃতিকভাবে যেন হারিয়ে ফেলেছি। রাস্তাঘাট, সোডিয়াম লাইট, কিছু বড়সড় ইমারত, হোটেল, অফিস-আদালত হয়েছে বটে, ’৭৯-এর সেই প্রাণবন্ত, প্রাণোচ্ছল, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর কিশোরীটিকে যেন আর খুঁজে পাইনি ’৯২-তে। কক্সবাজার আমায় অনেক দিয়েছে। প্রাণভরে উপভোগ করেছিলাম জীবনের শ্রেষ্ঠতম ওই দেড়-দুই বছর, যা ছিল পরবর্তী জীবনে চলার পথের পাথেয়।
এখনো আমার মনে আছে ’৭৯-এর কক্সবাজারের ষড়্ঋতুর প্রতিটি মুহূর্তের অনুভূতি।
এরপর আরও দুয়েকবার যাওয়া হয়েছে সপরিবার; তবে ’৭৯-এর সেই...‘আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি...’, ‘তুমি নির্জন উপকূলে নায়িকার মতো...’, ‘আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়, মনে পড়ে মোরে প্রিয়...’, ‘ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে, এ মধু রাত নাহি বাকি...’, ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে...’, ‘ওই সাগর বেলায় ঝিনুক...’, এসব গানের মাধুর্য, মাদকতা আর খুঁজে পাইনি।
তখন থেকেই কক্সবাজার, সেই কিশোরী সাগরকন্যাটি যেন একান্তই আমার সম্পত্তি হয়ে আছে মনে মনে।
যখনই যে কেউ কক্সবাজার বেড়ানোর গল্প বলেছে, স্মৃতিচারণা করেছে, মনে হয়েছে, এ যেন আমার সম্পত্তিতে অযাচিত হস্তক্ষেপ!
*লেখক: আহসানুল ইসলাম, ৬০০, পশ্চিম নাখালপাড়া, তেজগাঁও, ঢাকা
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]