‘এ–ই কি মানুষজন্ম?’

Md. Rashedul Alam Rasel

আব্বা কোনো দিন আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেননি। তিনি স্বপ্ন দেখতেন তাঁর অন্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে। আমাকে নিয়ে স্বপ্ন না দেখায় তাঁর ভুল ছিল না। কিংবা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপারও ছিল না। আমার জীবন এত অতিশয় অপ্রধান আর এতটা অনিশ্চয়তায় ভরা যে আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাটা ভীষণ দুর্লভ চিন্তাই বটে। আমি বাঁচব কি মরব, তারই তো কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না। এই মরে যাচ্ছি, এই বেঁচে উঠছি। কত বাঁচামরার গল্প আছে!

কয়েক দিন আগের কথা, মিরপুর পল্লবীতে নোয়াখালী জিলা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ফোরামের সভা হলো। যাঁর বাসায় দীর্ঘ সময় চলা ওই সভায় ছিলাম, তাঁকে আমি চিনতাম না, তিনিও আমাকে চিনতেন না। সভা শেষ হওয়ার পর তিনি আমার পরিচয় জানলেন। সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসক আহমেদ করিম বললেন, ‘তুমি সেই ছেলে! পিজি হাসপাতালে যার অ্যানেসথেসিয়া আমি করেছি। তুমি জানো, সেদিন বাঁচতে না। তোমাকে বাঁচানোটা মুশকিল ছিল।’ শুধু এ কথা বলে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, আবেগে আপ্লুত হলেন। আমি নিজেও কিছুটা সময় অনুভূতিহীন ছিলাম। তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর স্ত্রীর কাছে গেলেন। পরিচয় করালেন। তখন তাঁর চোখ জ্বলজ্বল করছিল।

তিনি আবার সবাইকে দেখাচ্ছেন, ‘দেখো, ওর মাথায় যে দাগ দেখছো, এটা সেই অপারেশনের দাগ।’ কেউ যখন এ দাগের কথা জিজ্ঞেস করত, আমি খুব মজা করে বলতাম, রামদা দিয়ে কোপানো দাগ। তিনি আরও যে কথা বললেন, ‘এই ব্রেনে চলাফেরা কঠিন। কিন্তু ও পারছে। কীভাবে পারছে আমি জানি না।’

আব্বার মতো আমি হতে পারিনি। কার মতো হয়েছি আমি? কারোর মতোই হতে পারিনি। এমনকি আমি আমার মতোও হতে পারিনি। আমাকে নিয়ে আব্বা গৌরব বোধ করতেন না। আমি তাঁকে সেই সুযোগ দিতে পারিনি। আমি আমার অন্য ভাইবোনদের মতো আভিজাত্য ও ঐশ্বর্যময় জীবন তাঁকে দিতে পারিনি।

২.
আমার জীবনের শুরুটা এক বিষণ্ন বিকেলে। সেইকালে জন্ম, যে কালে অত্যাবশকীয়ভাবে একটা পুত্রসন্তান জন্ম নেওয়া মানে অনেক বড় ব্যাপার। অনেক আনন্দের ব্যাপার। সেখানে একটি প্রভাব–প্রতিপত্তিশালী পরিবারে নেমে এল সারা জীবনের বিষাদ। এ কারণে আমার আম্মাকে নানা যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, নানাজনের নানা কটু কথা শুনতে হয়েছে। একটা প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম দেওয়া একটা মায়ের বড় অপরাধ, জীবনের বাঁকে বাঁকে তাঁকে অসহায় হতে হয়েছে।

জীবনের নানা অলিগলিতে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত পার করে আমি ‘হাবীব ইমন’ হয়েছি খুব ছোট করে। নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ আমার ছিল না। কোথাও কোনো জায়গায় স্থির হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আমার কোনো ওড়াউড়ির স্মৃতি নেই, আমার কোনো শৈশব-কৈশোর নেই। সেই সব আনন্দের কথা আমি খুব একটা বলতে পারি না।

ভীষণ সংকুচিত আমার জীবন। থেমে থেমে চলা এ জীবন। একটু এগোচ্ছি, কিন্তু পিছিয়ে পড়ছি তার চেয়ে বেশি। সমস্যা আর সংকটের ভেতর দিয়ে আমার প্রতিনিয়ত কেটেছে, কেটে যাচ্ছে। আমার একেকটা রাত স্বপ্নহীন, একেকটা ঘুম স্বপ্নহীন। আজকাল ঘুমের মধ্যে আমি ভীষণ আঁতকে উঠি। কাঁপুনি ধরে। স্বপ্ন দেখতে, বড় হতে কলিজা লাগে, আমার সেই কলিজা নেই। পাথরকুচির মতো দুঃখগুলো কেবল এখানে-ওখানে ছড়িয়ে যাচ্ছে অনবরত।

আমার চারপাশে এত মানুষ, এত মানুষ; কিন্তু আমি বড্ড একা। আমার নিজের মতো কোনো মানুষ নেই। আমার কোনো লাবণ্য নেই, যার প্রভায় আমি বিকশিত হতে পারি বা পারব। আমি সেই মানুষ, যাকে মাথায় তুলে আছাড় মারা যায়। যার মধ্যে ভালোবাসার গন্ধ ছড়িয়ে প্রত্যাখান করা যায়। যাকে অনবরত কষ্ট দেওয়া যায়। যেমন খুশি তেমন সাজোর মতো আমাকে নানা পাত্রে সাজিয়ে আঘাত করা খুব সহজ। অপমান করা আরও সহজ।

মাঝমধ্যে খুব অবাক হই, কীভাবে বেঁচে আছি। এই বেঁচে থাকা কি জরুরি? কেনই বা জরুরি? কেন মানুষের এমন নির্মম আচরণ বয়ে চলতে হবে? কোনো একক মানুষের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ যদি থাকে, তা আমার জন্মের প্রতি বিস্তর অভিযোগ। কেনই বা আমার জন্ম হলো? আজকাল আমি নিজেকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে কুণ্ঠা বোধ করি, বড্ড সংকোচ বোধ করি। এত দিন একা লড়াই করতে আমি আর পারছি না। আমাকে করুণভাবে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। করুণা নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। এটা যে কত বড় লজ্জা আর গ্লানির, তা হয়তো ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। কবে নিঃশেষ হব, তার জন্য অধীর অপেক্ষা করছি। যেদিন আমি সত্যি ক্ষয় হয়ে যাব, মাটিতে আমার কঙ্কালসার মিশে যাবে, তখন হয়তো নিখিলেশ এসে দেখে যাবে আমাকে, তার মনে নিশ্চয়ই এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে—এ–ই কি মানুষজন্ম?

  • লেখক: হাবীব ইমন, প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন