জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের স্বপ্ন কি কেবলই স্বপ্ন

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

জুলাই অভ্যুত্থানের দেয়ালচিত্রছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন লাল–সবুজ পতাকাটি পেয়েছে, এটা অবধারিত সত্য। তার সূত্র ধরে বাংলার জনগণের চাওয়া ছিল স্বাধীন দেশে নিজেদের মতো করে দেশটাকে গড়ার। যেখানে থাকবেন না পরাধীনতার শিকল। থাকবে মুক্ত আকাশে ডানা মেলে ওড়ার মতো পরিবেশ। মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশ থাকবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু দুঃখিনী মায়ের সন্তানেরা স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও লড়াই করছে নিজেদের মৌলিক অধিকারগুলোর জন্য। নানা সময়ে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। আর সে ধারাবাহিকতায় গত ২৪ জুলাই সব আন্দোলনকে ছাড়িয়ে গেছে। নিজের দেশের মানুষকে গুলিতে নিহত করেছে ১৯৭১ সালের মহানায়কের কন্যা শেখ হাসিনা। এটা সত্যি স্তব্ধ করে দিয়েছে দেশকে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের লড়াইগুলো কোনো ভিন্ন দেশের সঙ্গে হয়নি। সব লড়াই হয়েছে দেশের শাসকগোষ্ঠীদের সঙ্গে। এ লড়াইয়ের সূত্রপাত্র হয় নানা সময়ে নানাভাবে। তবে ১৯৭১ সালকে নিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি হয়, তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হলো জনযুদ্ধ। একমাত্র রাজাকার আলবদর বাহিনী ছাড়া প্রতিটি পরিবার কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।

চব্বিশের জুলাইয়ে শেখ হাসিনার একটি তাচ্ছিল্যকর শব্দ ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ শুনে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের জনগণও রাস্তায় নেমে আসে প্রতিবাদ জানাতে। সন্তানকে রাস্তায় নামিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি মৃত্যু হতে পারে জেনেও। সেই দিনগুলোতে আওয়ামী সরকারের হিংস্ররূপ দেখে বিস্মিত হয়েছে সারা দেশ। একজন মায়ের সন্তানের লাশ হাজারো মাকে কাঁদিয়েছে। স্বাধীন দেশে এমন গুলির শব্দ মেনে নেওয়ার মতো কোনো যুক্তি ছিল না। এমন বাংলাদেশ কারো প্রত্যাশায় ছিল না সে সময়। তাই মানুষ মনে করে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে সন্তানহারা মায়েদের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। এটা কোনো রাজনৈতিক দল বা দলের প্রধান হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। বিবেকবান মানুষ হয়ে ভাবা উচিত। মানুষের জীবন ও ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়—এ বাস্তবতাকে মানতে পারলে মানুষ কখনো হিংস্র মনোভাব লালন করতে পারে না।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক বছর পার হলো। সন্তানহারা মায়েদের শোক কোনোদিন কেউ ভুলিয়ে দিতে পারবে না। তবে তারা চায় তাদের সন্তানদের স্বপ্নটা সত্যি হোক। কিন্তু ক্রমশ সে স্বপ্ন যেন দূর আকাশের তারা হয়ে উঠেছে। কারণ, অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আর উপদেষ্টা পরিষদের টালমাটাল পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে সুবিধাবাদীরা। কখনো এ সরকার পরিষ্কার কিছু বলতে পারে না। কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল নতুন প্রজন্ম দেশকে নিয়ে ভাবে। তারা কেবল মোবাইল আর ইন্টারনেটে ব্যস্ত থাকে না। তাই তরুণদের দেখা স্বপ্নের বাংলাদেশ সবার স্বপ্ন হয়ে উঠলেও আজ সে স্বপ্ন কী ধারায় আছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররাও আজ নিজেদের এমপি বা মন্ত্রী হিসেবে দেখতে চায়। আর এ কাজটার বীজ বপন করেছে ছাত্রদের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করার মাধ্যমে। প্রতিটি আন্দোলনের সূচনা ঘটায় ছাত্ররাই। বিজয়ের পর তারা ফিরে যায় তাদের পড়ালেখায়। এবারও তাই হওয়ার কথা। কোটা আন্দোলন শেখ হাসিনার অদূরদর্শিতার জন্য সরকার হটানোর আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল এ কথা যেমন সত্য, তেমনি জুলাইয়ের আন্দোলন সফল হওয়ার পর ছাত্রদের পড়ালেখা আর ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে সরকার ও মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করাটা হতো যথাযথ। তা না করে তারা যখন সরকার ও বিভিন্ন স্থানে পদবি নিয়ে আসীন হয়, তখন তারা তাদের আন্দোলনের শপথ থেকে অন্য পথে চলতে শুরু করে। সোজা কথায় বলা যায়, ক্ষমতার মোহ থেকে তারা আলাদা হতে পারছে না। গতানুগতিক রাজনীতির ধারায় দেশে জন্ম নিয়েছে নতুন আরেকটি দল এনসিপি-জাতীয় নাগরিক পার্টি। তাদের ভাষ্যমতে, বিগত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের মানুষ সত্যিকারের নাগরিক অধিকার ও সুবিধা পায়নি। এ ৫৩ বছরের ইতিহাসে কেবল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল না। এ দেশকে শাসন করেছে সামরিক বাহিনী, বিএনপি ও এরশাদের জাতীয় পার্টি। ’৯০–এর গণ–আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি; সে অঙ্গীকার কোনো দলই পালন করেনি। বরং যে যার মতো করে নিজেদের দুর্নীতির মধ্য দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। সে সময় বিএনপি বিনাশের পথে চলে গিয়েছিল। জনগণ মনে করেছিল ১/১১ থেকে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ শিক্ষা নেবে। কিন্তু তা হয়নি, বরং বিএনপির চেয়েও আরও ভয়ংকর পথে চলতে থাকে আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধকে আজ তাদের জন্য ক্ষত–বিক্ষত হতে হচ্ছে। তবে মুক্তিযুদ্ধ মানে আওয়ামী লীগ নয়। এ কথাটা বর্তমান প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে। আজ যে মাটিতে দাঁড়িয়ে তারা কথা বলছে, তা কিন্তু অনেক মানুষের রক্ত আর মা–বোনের সম্ভ্রম হারানোর বিনিময়ে পাওয়া।

দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটা বিষয় সুস্পষ্ট, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সরকার এখন নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিতে চায়। জুলাই আন্দোলনের আবেগ যে অনেকটাই হারিয়ে গেছে, তার প্রমাণ হলো জুলাই ঘোষণাপত্র। এখন পর্যন্ত আওয়ামী সরকারের রাষ্ট্রপতি বহাল তবিয়তে। এ রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। অধ্যাপক ইউনূস তরুণ প্রজন্মের হাত ধরেই ক্ষমতা বসেছেন। কিন্তু এখন তিনি তরুণদের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার প্রথম বিনাশ ঘটিয়েছেন তাদের দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের মাধ্যমে। বছর না ঘুরতেই জুলাই আন্দোলনের ক্রেডিট নিতে ভাগাভাগি শুরু হয়ে গেছে রাজনৈতিক দল আর ছাত্রদের মধ্যে। আন্দোলনকে যদি সত্যি সবাই ধারণ করত, তাহলে অন্তত ৫ আগস্ট একসঙ্গে পালন করত।

সবকিছু মিলিয়ে জুলাইয়ের ৩৬ দিন এখন কেবল রাজনৈতিক ভাষণের একটা অংশ মাত্র। দলগুলোর ভাব–ভঙ্গিতে মনে হয় জুলাই ছিল তাদের ভোটের অধিকার পাওয়ার আন্দোলন। তা কিন্তু নয়। সর্বতোভাবে সত্য হলো, মা–বাবারা সন্তানদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ চেয়েছিলেন বলেই সন্তানদের গুলির মুখে প্রতিবাদ করতে যেতে সম্মতি দিয়েছিল। স্বাধীন দেশের মুক্ত বাতাসে শোষণহীন বৈষম্যবিরোধী সরকার পাবে কি না, তা অনিশ্চিত। তাই তরুণদের দেখা স্বপ্ন কেবলই স্বপ্ন হয়ে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, এটাই সত্য। আজ এটা বলতেই হবে, বিগত ১৬ বছরে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে রাস্তায় নামাতে পারেনি। একইভাবে প্রবাসীদের পাশে পায়নি আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে। কিন্তু দেশের মাটিতে নিজের সন্তানের মতো আরেক মায়ের সন্তানের গুলিবিদ্ধ দেহ বা লাশ দেখে তারা বসে থাকেনি। সোচ্চার হয়েছিল। জুলাই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে আন্দোলনের ছাত্রদের স্বপ্নকে বিনাশ করছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এত বড় আন্দোলন বারবার হয় না। তাই তরুণ প্রজন্মের নেতাদের ভাবতে হবে তাদের চলার পথ নিয়ে। কারণ, রাজনীতিতে আবেগের কোনো দাম নেই।