একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি
বাসার সামনের বিদ্যুতের খুঁটিতে সাঁটানো বিজ্ঞপ্তি দেখে দুই চোখ আটকে গেল! একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি। সাভারের চাঁপাইন এলাকার জনৈকের একটি বিড়াল হারিয়ে গেছে। নাম পাখি। পাখিকে তিনি ছয় বছর ধরে পুষছেন। দুই দিন হলো, হঠাৎ পাখি উধাও! কোনো খোঁজ মিলছে না। খোঁজ পেতে জনৈক বিজ্ঞপ্তিটি দিয়েছেন। বিড়ালের মালিকের কথা ভেবে মনটা আচমকা ব্যথিত হলো। মনে মনে ভাবলাম, পাখিকে হারিয়ে বেচারা না জানি কত কষ্টে আছেন!
গলির পথ ধরে এগোতে দেখি, বিভিন্ন বাসাবাড়ির দেয়াল, বিদ্যুতের খুঁটি, সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রাচীর ভরে গেছে বিজ্ঞপ্তিতে। মনে হলো, মালিক পাখিকে ফিরে পেতে সব চেষ্টাই করছেন। আর করবে নাই–বা কেন, ছয় বছর ধরে পোষা প্রাণী বলে কথা।
আমি যে বাসায় ভাড়া থাকি, বাসার মালিক সোবহান আঙ্কেল একজন সজ্জন ব্যক্তি। দীর্ঘ ২২ বছর ইউরোপে ছিলেন। কয়েক বছর হলো দেশে ফিরে এসে মানিকগঞ্জ থেকে সাভারে থিতু হয়েছেন। আঙ্কেল একজন বিড়ালপ্রেমিক। কিট্টি, ক্যান্ডি ও বুলবুলি নামে তাঁর তিনটি বিড়াল আছে। বিড়ালগুলোর সঙ্গে তাঁর দারুণ ভাব! তিনি যখন বাগান পরিচর্যার জন্য তিনতলা থেকে নিচে নেমে আসেন, বিড়ালগুলো পিছু নেয়। কখনো গাছের ডালে চড়ে, কখনো সি আর পির প্রাচীরের ওপর উঠে লাফালাফি শুরু করে। আঙ্কেল ওদের ‘ওই, ওখানে যাবি না, নিচে নেমে আয় বলছি’ ইত্যাদি বলে মৃদু শাসন-বারণ করেন। বিড়ালগুলো সঙ্গে সঙ্গে টুপ করে নেমে এসে ‘মিউ মিউ’ বলে আঙ্কেলের চারপাশে ঘুরতে থাকে। আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য প্রায়ই উপভোগ করি।
নাগরিক সংবাদ-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
সপ্তাহখানেক হবে, আঙ্কেলকে দেখে চিন্তিত মনে হলো। কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘তিন দিন ধরে কিট্টি অসুস্থ। খাওয়াদাওয়া করছে না। গায়ে ১০৬ ডিগ্রি জ্বর। ছেলেকে দিয়ে সাভার প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু চিকিৎসক রোগ নির্ণয় করতে পারেননি। আজ ধানমন্ডি পাঠিয়েছি এক প্রাণী–বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে। বিভিন্ন টেস্ট দিয়েছে। টেস্টে লাং আক্রান্ত হওয়ার রিপোর্ট এসেছে। চিকিৎসক জানিয়েছেন, দ্রুত চিকিৎসা করাতে হবে, না হলে বেঁচে থাকার সম্ভবনা খুবই কম। এদিকে কিট্টির খবরে বাসার সবাই খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে খুব টেনশনে আছি।’ আঙ্কেলের কথা শুনে আমার খুব খারাপ লাগল। কারণ, ইতিমধ্যে তাঁর পরিবারের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
পরের দিন বিকেলে সোবহান আঙ্কেলকে দেখে ফুরফুরে মেজাজে আছেন মনে হলো। কিট্টির খবর জানতে চাইলে বলেন, ‘আগের চেয়ে ভালো। একটু একটু করে খাওয়াদাওয়া করছে। গায়ের তাপমাত্রাও স্বাভাবিক।’
কিট্টির অবস্থার উন্নতির কথা শুনে আমার খুশি লাগল। কেননা এত দিনে বিড়ালগুলো আমার আপন হয়ে উঠেছিল।
এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে। আমাদের বিল্ডিংয়ের পাশে একটি আধা পাকা পুরোনো বাসা। বাসার সামনে একটি ছেলেকে প্রায়ই দেখি হুইলচেয়ার পেতে বসে আছে। বয়স ১৩ কি ১৪ হবে। একসময় জানতে পারি, ছেলেটির নাম বিল্লাল। বাড়ি চাঁদপুর জেলায়। প্রায় তিন বছর আগে মাদ্রাসায় যাওয়ার পথে মোটরসাইকেলের সঙ্গে তার দুর্ঘটনা ঘটে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে চাঁদপুর সদর হাসপাতাল এবং পরে সাভারের সিআরপিতে ভর্তি করানো হয়। মাঠে যতটুকু কৃষিজমি ছিল, এরই মধ্যে তা চিকিৎসার পেছনে শেষ! বর্তমানে বিল্লালের মা বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে ছেলের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর স্বপ্ন, বিল্লাল একদিন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাবে।
শীতের মাঝামাঝি সময়। একদিন বাসার সামনে শুনি, হল্লা হচ্ছে। গলা শুনে বিল্লালের মায়ের মনে হলো। কৌতুহলবশত আর দুই–চারজনের সঙ্গে আমার স্ত্রীও এগিয়ে যায়। পরে শুনি, বিল্লালের জিলাপি খুবই পছন্দ। মাঝেমধ্যেই বিল্লালের মা গলির মাথার দোকান থেকে জিলাপি এনে দেন। গতকালও ১০ টাকার জিলাপি এনে দিয়েছিলেন। আজ আবার বায়না ধরেছে জিলাপি খাবে। কিন্তু তিনি কাজ করে যে কয় টাকা পান তা দিয়ে ছেলের চিকিৎসা করানোই কঠিন, তার ওপর রোজ রোজ জিলাপি খাওয়াবেন কী করে, তাই তিনি হল্লা করছেন। বিল্লালদের এমন আর্থিক দুরাবস্থার কথা শুনে আমার খুব কষ্ট লাগল। আর কষ্ট লাগা ছাড়া করারই কি আছে বৈকি!
কিছুদিন পর। কয়েক দিন হলো বিল্লালের সঙ্গে দেখা নেই। ভাবলাম গ্রামে বেড়াতে গেছে হয়তো। খোঁজ নিয়ে জানলাম, চিকিৎসা বাদ দিয়ে বিল্লালরা গ্রামে ফিরে গেছে। কারণ, বিল্লালের মা এত দিন যে ভদ্রলোকের বাসায় কাজ করতেন, তিনি বদলি হয়ে অন্যত্র গেছেন। এ ছাড়া তিনি যে ফিজিওথেরাপি সেন্টারে ধোয়ামোছার কাজ করতেন, তারা নতুন লোক নিয়েছে। দুই-চার দিন নতুন কাজ খোঁজ করে না পেয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। যাওয়ার সময় আফসোস করে বলেছিলেন ‘আহা! ট্যাকার অভাবে বাবাডারে চিকিৎসা করাইতে পারলাম না।’
আজ দেয়ালে দেয়ালে বিড়াল হারানোর বিজ্ঞপ্তি দেখে বিল্লালকে খুব মনে পড়ছে!
লেখক: রিজভী আহমেদ, নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম