ফরিদপুরের মজলিশপুরে নামসংকীর্তন
একটি মাত্র দিন হাতে। তারপর আরও কাজ সামনে।
সেদিন ২১ ফেব্রুয়ারি। রাতে বসতে হবে ভিন্ন এক বিষয় নিয়ে ভিন্ন কোনো জায়গায়। যাওয়ার আগে এ জন্যই ফেরার প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে।
মজলিশপুর গ্রামের সর্বজনীন আয়োজন। প্রতিবছর গ্রামবাসী নামকীর্তনের ব্যবস্থা করে থাকেন। এবার ৩৭তম বর্ষ চলছে। আমরা নিমন্ত্রিত হয়েছিলাম সেখানে।
লক্ষ্মীপ্রিয়া সম্প্রদায় তখন আসরে। সবাই নামের সঙ্গে মিলে গেছেন।
চার যুগ। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। কলিকাল চলছে। ভক্তরা জানেন, এ কালে নাম ছাড়া কোনো ধর্ম নেই। কৃষ্ণ নামের মধ্যেই সব মন্ত্র, তাবৎ পুণ্য বিরাজমান। সেই নামকীর্তনে আছে আনন্দ। আর এর পূর্ণতা প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে।
আমরা এই যে এলাম। সেও প্রকৃতির সঙ্গে। নৈসর্গের কীর্তনই করলাম। তা না হলে আর সেই কয়েক যুগকে দৃশ্যপটে আনা কেন? চন্ডিবর্দি, বল্লভদি, বাউসখালী গ্রামের মধ্য দিয়ে চলেছি। সনাতনদি ডানে রেখে পুরাপাড়া হয়ে দফা মজলিশপুর। এই পথ, এই ধুলা, এই গাছ, এই পাখি, এই গান। কিছু বাদ পড়ল কি? ও হো, ‘তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম। সে এখন ঘোমটা পরা কাজল বধূ দূরের কোনো গাঁয়। পথের মাঝে পথ হারালে আর কি পাওয়া যায়। ...’
লিপিকা আমার ভাগ্নি। আছে অরবিন্দ রায়। ওরা দুজনই স্কুলশিক্ষক। সে গল্প এখনকার না। ভালো লাগে লিপির স্কুলজীবনের কাহিনি। ও মূলত আমাদের বাড়ি চাঁদহাট গ্রামে মানুষ। সেই স্কুল, মেঠোপথ, আমবাগান—সবই আসে। শোনে সে কথা আমারই কন্যা দূর্বা। আমরা মিলিয়ে নিই আমাদের বাল্যজীবন। লিপির গল্প শেষ হয় না। আসে পূর্বার নাম। সেই যে পেঁয়াজের চারা রোপণের নতুন অধ্যায়।
পেঁয়াজের ভূঁইয়ের আলপথে নিজেকে দেখি। রাগদা বিলের মধ্য দিয়ে সোজা পথে হাঁটি। সতল জলে যাই পুব থেকে পশ্চিম পাশে। পাখিরা উড়ে যায় ফরফর করে। সংবিৎ ফিরে পাই আচমকা।
আয়োজনের পক্ষ থেকে দেশমাতৃকা ও বিশ্বজননীর সব সন্তানের মঙ্গল কামনা করা হয়েছে। সাতটি দল। প্রত্যেক সদস্যই যেন বুকের মধ্যে ধারণ করেছেন দেশের নামটিও।
বাগেরহাট থেকে এসেছে দুটি দল। শিবশঙ্কর সম্প্রদায় ও বৃন্দাবন সম্প্রদায়। গোপালগঞ্জ থেকে সত্য সনাতন সম্প্রদায়, প্রভুপ্রিয়া সম্প্রদায়, লক্ষ্মীপ্রিয়া সম্প্রদায় আর মীরা সম্প্রদায়। শান্তিনিকেতন সেবা সংঘের ঠিকানা মানিকগঞ্জ।
আয়োজনের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ যেন নামের বাগিচা। ভাবগাম্ভীর্যময় সময় চলছে তখন। প্রভুপ্রিয়ার অণিমা বাইন মূল কেন্দ্রে। ‘সাধু সাধু’ বলে শ্রোতারা মুগ্ধতা প্রকাশ করছেন।
এর আগে আমাদের স্বাগত জানানো হয়। হ্যাঁ, উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি অশোক কুমার বিশ্বাস ছিলেন অগ্রভাগে। বসালেন নির্দিষ্ট স্থানে। আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় হয়। আমার সহধর্মিণী লাকি হালদার উল্কার মূল্যায়ন আমার মতোই। এমন একটা অনুষ্ঠান আয়োজনে আসা শুধু বেড়ানো নয়। বহু গ্রামের মানুষের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ও বটে।
এদিকে আর একদল অতিথি নিয়ে এলেন রঙ্গেশ্বর বিশ্বাস। কথা হয় বাউসখালী হাইস্কুল নিয়ে। একই স্কুলে শিক্ষকতা করেন আমার ভাই অলক সরকার। স্কুলটি একটা সমস্যা পেছনে ফেলে এল। অতিথিদের একজন বল্লভদি ইউনিয়নের আহসান হাবিব। অন্যজন তাঁর বন্ধু মাইনুদ্দিন ফকির। পরিচয় করে দিলেন আমাদের সঙ্গে। দেশগাঁয়ের খবর নিলাম। শুভেচ্ছা বিনিময় হলো এই গ্রামেরই এক যুবক নুরুল ইসলামের সঙ্গে। হাত মেলালাম।
কথা হলো আয়োজনের প্রচার সম্পাদক অনন্য বিশ্বাসের সঙ্গে। অনুষ্ঠান শেষ হচ্ছে আগামীকাল (২২ ফেব্রুয়ারি)। কীর্তনিয়ারা ভ্রমণ করবেন গ্রাম। শীতলতার প্রতীক জল। বাড়ির অঙ্গনে সেই জল ঢেলে পরিশুদ্ধ করবে গোটা অঞ্চল। অন্যদিকে দধি হচ্ছে শুভ্রতা বা পরিচ্ছন্নতার রূপক। তাবৎ পল্লি দধিস্নানে হবে পবিত্র। মঙ্গল গানে ভরে উঠবে চারপাশ।
নামকীর্তনের আগের পর্বে ছিল ভাগবত পাঠ। মহারাজপুরের স্বপন কুমার গোস্বামী, ঝিনাইদার রাইকিশোরী দাসী আর যশোরের মৃত্যুঞ্জয় দাস অধিকারী। তিনজনই ভাগবতের অমৃত কথা শুনিয়েছেন। মৃত্যুঞ্জয়–কন্যা জয়শ্রী অধিকারী এখানে দুধে চিনির সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। ভজন সংগীত সংযোজন করে পরিবেশকে তিনি উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। গৌরবের সমাচার রাইকিশোরী নিজে। ফার্মেসির তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। পড়ছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই সমাজের অহংকার। আর স্বপন কুমার, তিনি যে স্বপ্নচারিণী, ভাগবতশাস্ত্রী।
রূপাপাত গ্রামের কৃষ্ণ সাহা। শৈল্পিক ডেকোরেশন তাঁর। জ্বলজ্বল করছে চারপাশ। চাঁদহাট গঙ্গাখোলা নিয়ে কথা হয়েছিল। অন্য জায়গায় বড় বাজেটে অনুষ্ঠান করা হয়। আমার গ্রামের ছেলেদের ক্ষুদ্র আয়োজন। কৃপা আচার্যের কবিতা শুনেছিলাম। আর বলেছিলাম, ‘তঙ্কা তঙ্কাহি কেবলম...তঙ্কাহি কেবলম’ যেন ব্রত না হয়। এদের কাজটি করতে হবে ভালোবাসায়। বলেছিলেন, ভালোবাসা প্রথম, টাকা দ্বিতীয়। সেদিন কথা হয়েছিল ফোনে, আজ সাক্ষাতে। বিষয়টি এবারও সামনে এল। বিষয়টি ধন্যবাদের।
উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রাণগোপাল বিশ্বাস। বললেন, এক শ ষাট সদস্যের আয়োজন। মনের জোর আছে বলেই তাঁদের নিয়ে মহাযজ্ঞ করা সম্ভব হলো।
আমরা ফেরার পথের যাত্রী তখন। নগরকান্দা থানা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি মনোরঞ্জন বিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি নগরকান্দা কলেজের সাবেক প্রাধ্যক্ষ। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানালাম।
জীবন বিশ্বাস জোর হাতে আমার সামনে দাঁড়ালেন। এ বুঝি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি! ওই যে নিতাই।...আরও আরও কর্মীর সমাবেশ। ভুবন বিশ্বাস, অরুণ বিশ্বাস। বারোয়ারি এসব অনুষ্ঠানের শক্তিশালী সংগঠক তাঁরা। জানালেন চলমান আয়োজনের সভাপতি। আমি অভিনন্দন জানালাম।
আমরা আপ্যায়িত হলাম। দেখলাম, এখানেও শামিল আমাদের দুই বউমা লক্ষ্মী আর রত্না। ওদের আন্তরিক সেবা ও আপ্যায়ন অনুষ্ঠানকে আরেক মাত্রা ওপরে তুলল।
এত সেবা, এত আপ্যায়ন, এত উদ্যাপন। এত যে সংকীর্তন। ধরে রাখতে পারে না আমাদের দলকে। ওই যে বলেছিলাম সেই শুরুতে!
কাজ আছে, কথা আছে, আছে অন্য জল্পনা।
সংসার হেঁটে চলে, দিব্যি মনের বলে, করি সেটা কল্পনা।
অতএব বিদায়।
*লেখক: নিমাই সরকার: প্রকৌশলী, কথাসাহিত্যিক