প্রথম আলোর ঝরনাধারায়

১৯৯৮ সালের ৩ অক্টোবর প্রথম আলোর প্রকাশপূর্ব সুধীসম্মেলনে বাঁ থেকে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, কাজী ফজলুর রহমান,আতহার আলী খান ও সৈয়দ আলী কবিরছবি: প্রথম আলো

১৮১৮ সালের ২৩ মে বাংলা ভাষায় প্রথম পত্রিকা সমাচার দর্পণ প্রকাশিত হয়। মজার ব্যাপার, ঐতিহাসিক এই ঘটনা শুরু হয়েছিল কয়েকজন ইংরেজের হাত ধরে। খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারক জোশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড ছিলেন পত্রিকাটির উদ্যোক্তা। জোশুয়া মার্শম্যানের ছেলে সাংবাদিক জন ক্লার্ক মার্শম্যান সমাচার দর্পণের প্রথম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন; যদিও পেছন থেকে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতেন তৎকালীন বাঙালি পণ্ডিতেরা। ১৮১৮ সালের পর সূর্যকে ২০৫ বার প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী। দেশের সংবাদপত্র হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়েছে বহুদূর। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পরবর্তী সময়ে স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর সময়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দেশের পত্রিকাগুলো রেখেছে অসামান্য অবদান।

পত্রিকার সঙ্গে আমার সখ্য শুরু সেই স্কুল থেকে, আশির দশকে। তখন বাসায় রাখা হতো দৈনিক ইত্তেফাক আর আম্মার জন্য সাপ্তাহিক বেগম। সেই বয়সে আমার আর বড় ভাইয়ের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল খেলার পাতা। চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকতাম কখন পত্রিকা আসবে। আমরা তখন থাকতাম মণিপুরিপাড়ায়। সকাল সকালই পেয়ে যেতাম পত্রিকা।

আরও পড়ুন

১৯৮২ সালে আমরা চলে আসি মিরপুরের কাজীপাড়ায়। এলাকাটা তখন একদমই গ্রামীণ। মনে পড়ে, আমাদের বাসার সামনে তখন রীতিমতো ধান চাষ হতো। অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটার পর সেই জমিতে পিচ বানিয়ে হতো ক্রিকেট খেলা। কাজীপাড়ায় তখন পত্রিকা আসত বেশ দেরি করে—বেলা ১১টার দিকে। ভীষণ বিরক্ত আর অস্থির লাগত, কেননা ওই সময়ে আমাদের খেলাধুলাসংক্রান্ত সমস্ত তথ্যের অন্যতম সূত্র ছিল সবেধন নীলমণি ওই পত্রিকা। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাসায় ক্রীড়াজগৎ রাখা শুরু হয়। কৈশোরের সেই সময়ের অসংখ্য আনন্দের অন্যতম এক উপলক্ষ ছিল এই পাক্ষিক পত্রিকা। বিচিত্রাও রাখা হতো মাঝেসাজে। সেসময়ে আরেকটা অন্যতম আকর্ষণ ছিল ঈদ সংখ্যা। একসঙ্গে পেয়ে যেতাম অনেকগুলো উপন্যাস আর গল্প।
স্কুল শেষ করে ভর্তি হই ঢাকা কলেজে। অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা—বিশাল ক্যাম্পাস, সব সময় গমগম করছে শিক্ষার্থীদের প্রাণবন্ত উপস্থিতিতে। মনে হয়, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির।’ এরশাদবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। কলেজের করিডরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে গগনবিদারী স্লোগান—‘আমাদের ধমনিতে শহীদের রক্ত, এই রক্ত কোনো দিনও পরাভব মানে না।’ নিজের মননে আর চিন্তায় আসে পরিবর্তন। ধীরে ধীরে বাম আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে থাকি। ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন।’ শুরু করি প্রগতিশীল চিন্তার ধারক ‘সংবাদ’ পত্রিকা পড়া। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম তখন সংবাদে ‘গাছপাথর’ ছদ্মনামে লিখতেন ‘সময় বহিয়া যায়’ নামে জনপ্রিয় এক কলাম। ‘বৈহাসিকের পার্শ্বচিন্তা’ নামে আবুজাফর শামসুদ্দিনের লেখা কলামও ছিল বেশ আলোচিত এবং পাঠকপ্রিয়। মনে আছে, লেখাগুলো রীতিমতো গোগ্রাসে গিলতাম। কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র একতা পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিলাম সেই সময়ে। জনাব মতিউর রহমান ছিলেন এই সাপ্তাহিকীটির সম্পাদক। একতায় প্রকাশিত হিলাল ফয়েজীর রম্য কলামের ছিলাম একনিষ্ঠ ভক্ত।

ফাইল ছবি

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে একঝাঁক তরুণ তুর্কির হাত ধরে দেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয় আজকের কাগজ। ‘অগ্রসর পাঠকের দৈনিক’ আর ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নির্ভীক কণ্ঠস্বর’ স্লোগান নিয়ে পত্রিকাটি অল্প দিনেই অর্জন করে পাঠকপ্রিয়তা। এর অল্প কিছুদিন পরে আত্মপ্রকাশ করে আরেকটি নতুন পত্রিকা দৈনিক ভোরের কাগজ। সংবাদ ছেড়ে আমি তখন হয়ে যাই ভোরের কাগজের পাঠক।

১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর প্রথম আলো প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই আমি এই পত্রিকার একজন একনিষ্ঠ পাঠক। ২৫ বছর ধরে প্রথম আলো আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। মাঝে অল্প কিছুদিন পেশাগত কারণে দেশের বাইরে অবস্থানের জন্য, আর কোভিড মহামারি শুরুর প্রথম দিকে অজানা আতঙ্কে এ সম্পর্কে কিছুটা ছেদ পড়েছিল, মানে মুদ্রিত সংস্করণের সঙ্গে। ইন্টারনেট প্রযুক্তির কল্যাণে অনলাইনে পত্রিকা পড়া হতো সেই অল্প কিছুদিন। কোভিড আতঙ্ক কেটে গেলে দুই মাস পর থেকে আবার বাসায় প্রথম আলো রাখতে শুরু করি। হাতে নিয়ে খবরের কাগজ না পড়লে কেন জানি তৃপ্তি পাই না। সকালে কাজে বের হওয়ার আগে পত্রিকা পেলে ওটা হাতে নিয়েই বের হয়ে যাই, গাড়িতে পড়তে পড়তে পৌঁছে যাই কর্মস্থলে। না হয় অফিস থেকে ফিরে ধোঁয়া–ওঠা এক কাপ চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রথম আলো পড়া আমার দৈনন্দিন অভ্যাসের একটা আনন্দময় অংশ।

প্রথম আলোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক নতুন এক মাত্রা পায় ২০২০ সালে, যখন এই পত্রিকায় আমি টুকটাক লিখতে শুরু করি। আমার মতো অনেক অপরিচিত, শৌখিন এবং অপেশাদার লেখকের মতামত প্রকাশ করার এই অভাবনীয় সুযোগ করে দেওয়ার জন্য প্রথম আলোর প্রতি আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।

গত ২৫ বছরে প্রথম আলো ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে দেশসেরা সংবাদপত্র হিসেবে। সাহসী আর বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে পত্রিকাটি অর্জন করেছে পাঠকের আস্থা। আর সে জন্যই বর্তমানে প্রতিদিন সাড়ে ৫ লাখ কপি ছাপা হয়, ৫৫ লাখেরও অধিক পাঠক রয়েছে পত্রিকাটির। প্রথম আলোর ফেসবুক পেজের অনুসারী প্রায় ২ কোটি। এখানেই শেষ নয়। প্রথম আলো ডটকম এখন এক নম্বর বাংলা ওয়েবপোর্টাল। বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশ থেকে অনলাইনে এই পত্রিকা পড়া হয়। নিঃসন্দেহে অনন্য নজির। প্রথম আলো নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ যেন নিজের সঙ্গে নিজের এক অলিখিত প্রতিযোগিতা।

শুধু সংবাদপত্র হিসেবে নয়, প্রথম আলো পরিণত হয়েছে অনন্য এক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। নানাভাবে পাঠক তথা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ স্থাপন করে চলেছে প্রথম আলো। গণিত অলিম্পিয়াডের মতো আয়োজন এ দেশে হাজারো তরুণ-তরুণীকে উৎসাহিত করছে গণিত চর্চায়। দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনছেন অনেকেই। মেধাবী শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা, অসহায় মানুষের প্রয়োজনে তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর মতো অসংখ্য নজির স্থাপন করেছে প্রথম আলো। মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার এ দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে ইতিমধ্যে বাংলার অস্কার পুরস্কার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

আমাদের প্রত্যাশা পত্রিকাটি সত্য প্রকাশে থাকুক নির্ভীক। দেশের তরুণ প্রজন্মের মানস গঠনে আরও উদ্যোগী হোক তাদের লেখনী এবং নানা সৃজনশীল আয়োজনের মাধ্যমে, যাতে করে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয় মুক্তমনা, উদার, পরমতসহিষ্ণু এবং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দেশব্যাপী প্রথম আলোর যে বিশাল নেটওয়ার্ক, সেটা ব্যবহার করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলায় মেধাবীদের খুঁজে বের করে তাদের প্রতিভা বিকাশে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের দৃষ্টিগোচর করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে এই অনন্য প্রতিষ্ঠান। আমরা চাই এ দেশ, এ সমাজ হবে বুদ্ধিবৃত্তিক, উদার এবং মানবিক। আর এ কাজে প্রথম আলো রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

প্রথম আলোর ২৫ বছর পূর্তিতে শুভেচ্ছা আর অনেক অনেক শুভকামনা।
*লেখক: সাজ্জাদুল হাসান, একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত