বিসিএস ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা—‘বিসিএস হলো একের ভিতর সব’
পড়াশোনা একটি আপেক্ষিক বিষয়। অনেকে ধৈর্য ধরে পড়তে পারেন, অনেকে ঝরে পড়েন। উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে অ্যাডমিশন জার্নি শেষে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া অনেকের কাছে সোনার হরিণ হাতে পাওয়ার মতো মনে হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্নভাবে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষার্থীরা বিভাগ অনুযায়ী কেউ মেডিকেল, কেউ সরকারি–বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান। অনেকে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পায় না। তবে কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগের পরে কোন বিষয়ে অধ্যয়ন করবে, তার জন্য দৌড়াদৌড়ির শেষ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই, বড় আপুদের পরামর্শের কোনো অন্ত নেই। প্রক্রিয়া হিসেবে হোক আর পছন্দ অনুযায়ী হোক, অবশেষে একটি বিষয়ে ভর্তি হতেই হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ তো পেয়েছি, কেল্লাফতে, আর কি লাগে! কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আমি মনে করি, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত গণ্ডিটা নদীর মতো, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিটা সাগরের মতো। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন পরিবেশে শিক্ষার্থীদের খাপ খাইয়ে চলতে হয়। সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক, বিভিন্ন ক্যারিয়ার–সম্পর্কিত সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও বিভিন্ন জেলার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা—এভাবেই ধোঁয়াশার মধ্যে কেটে যায় অর্ধেক বছর। সেমিস্টার পদ্ধতিতে ডিপার্টমেন্টের পড়াশোনার চাপ, নিয়মিত ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট ও পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের পিছু ছাড়ে না। তখন জীবনটা অতিষ্ঠ মনে হয় যে কোথায় আসলাম। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া কোনো ব্যাপারই মনে হয় না। তবে কষ্টের ফল সুমিষ্ট হয় এটা সত্যি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ঐতিহ্য হলো গতানুগতিক বা বংশপরম্পরায় সিট পড়ে পরীক্ষা দেওয়া। তাই অনেক শিক্ষার্থী এসব নিয়ে প্যারা (রাজশাহীর ভাষায়) নেয় না। যদিও বর্তমানে কেউ পড়ে না, শুধু পরীক্ষা দেয়। বর্তমানে পরীক্ষার খাতায় বমি করে আসা হয়। আমি বলছিলাম বিসিএস ও বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে।
বিসিএস—
বিসিএসকে আমার একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সিবিএস (ক্রাইম বেসড সার্ভিস) বলেন। বিসিএস ক্যাডাররা অনেকে অনৈতিক তাদের সাথে যুক্ত থাকে। যদিও সাধারণকীকরণ করা ঠিক না। একটা বিষয় সুস্পষ্ট যে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা মানে হলো চাকরি পাওয়া। তার আগে চাকরি পাওয়া, প্রতিষ্ঠিত হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে চিন্তার ইয়ত্তা থাকে না। অনেক পরিবার থেকে এমন ধারণা পোষণ করে যে আমার সন্তান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিসি হয়ে বের হবে। যখন প্রথম বর্ষ শেষ হয়, তখন পারিপার্শ্বিকতা দেখে, বাস্তবতা বুঝে অনেকে সচেতন হয়। অনেকে ডিপার্টমেন্টে কাঙ্ক্ষিত ফল না করতে পেরে হতাশ হয়। তখন থেকেই তরুণ–তরুণীদের মাথায় বিসিএস নামক একটা ভূত চেপে বসে। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে ফ্রি বিসিএস মাইকিং তো আছেই। সেমিনারগুলোতে অংশগ্রহণ করলে মনে হয় জীবনে বিসিএস ছাড়া কিছু নেই। এ যেন মগজ ধোলাই করার ফাঁদ, দেশকে মেধাশূন্য করার ফাঁদ। যদিও বর্তমানে শিক্ষাকে অনেকে পুঁজিবাদে রূপান্তর করছে। তখন থেকেই সিলেবাসের এক সেট বই শিক্ষার্থীদের বগলদাবা করে ক্যাম্পাসে ঘুরতে দেখা যায়। প্রথম বর্ষ বা সেমিস্টারের যখন ফলাফল প্রকাশিত হয়, তখন বোঝা যায় কে কোন দিকে যাবে। তখন অনেকের ডিপার্টমেন্টের পড়াশোনা ভালো লাগে না। তা ছাড়া যাঁরা ডিপার্টমেন্টে টপার হন, তাঁদের আশা থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন। কিন্তু বাস্তবতা পুরোটাই ভিন্ন। মামা ছাড়া কাঙ্ক্ষিত সফলতা পাওয়া যায় না।
অনেক পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থী রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারছেন না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের নুরুল ভাইয়ের নিয়োগ কাহিনি সম্পর্কে সবাই অবহিত। বিশ্ববিদ্যালয় (২০১৭) ও প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক (২০১৮) পাওয়া সত্ত্বেও তাঁকে ঘুষ বা বিয়ের প্রস্তাবও দেওয়া হয়। যদিও বর্তমানে কিছু ক্ষেত্রে মেধাতন্ত্রকে মূল্যায়ন করা হয়। অনেকে বাস্তবতা বুঝতে পারেন। অনেক টপারের মুখে শুনেছি, ডিপার্টমেন্ট নাকি কিছু দেবে না। যদিও ওই কথার সঙ্গে আমার দ্বিমত আছে। তবুও এসব দার্শনিক কথা শুনে মাঝেমধ্যে অনেকে হতাশ হয়। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে কে কোন দিকটা বেছে নেবেন, ঠিক তখনই মাথায় আসে বিসিএস। আমার মতে, ‘বিসিএস হলো একের ভিতর সব।’
অনেকে বলেন, বিসিএস প্রস্তুতি নিলে নাকি যেকোনো চাকরি পরীক্ষার প্রস্তুতিও হয়ে যায়, চাকরি পাওয়াও অনেকটাই নিশ্চিত। তাই অনেকে বুকভরা আশা নিয়ে ওই পথে ছুটতে থাকেন। যা ম্যারাথন দৌড়ের অনুরূপ। অনেকে সমুদ্রে সাঁতার কেটে কিনারায় পৌঁছান। অনেকে অথই জলে ডুবে যায়। দিনশেষে একটা চাকরি পাওয়াই যখন মুখ্য তখন উক্ত পথে না যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়
অনেকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হলো বেকার তৈরির কারখানা। গভীরভাবে চিন্তা করলে কথাটির যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যাবে। বিবিএস (বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস) শ্রমশক্তি জরিপ (২০২৩) অনুযায়ী পুরুষ বেকারের সংখ্যা ১৫ লাখ ৭০ হাজার ও নারী বেকারের সংখ্যা ৭ লাখ ৮০ হাজার। দেশে ডিসেম্বরের শেষে বেকার বেড়ে হয়েছে সাড়ে ২৩ লাখ। তাঁদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীদের সংখ্যাটাই বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিসিএস যেন একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয় মানেই বিসিএস। আপনি খুবই কমসংখ্যক শিক্ষার্থীর মুখে শুনতে পারবেন যে বিসিএস ক্যাডার হতে চায় না।
সমস্যাটা কোথায়—
বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি কেউ বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য ভর্তি হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার দরকার নেই। ২১ শতকের পৃথিবীতে বিপুল জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করাই যখন মুখ্য বিষয়, তখন শুধু একাডেমিক জ্ঞান দিয়ে কাজ হবে না। কারিগরি ও ব্যবহারিক দক্ষতাও বাড়াতে হবে। সমস্যাটা হলো প্রাথমিক স্তর থেকে সব ক্ষেত্রেই যখন পরিবর্তন লক্ষণীয়, তখন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমাজ ও চাকরির বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগোপযোগী পরিবর্তন আনয়ন করা জরুরি। ওই বিষয়ে আমার ধারণা ব্যক্ত করার চেষ্টা করব।
কী করা উচিত—
অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিসিএস প্রস্তুতি নেয়, সবাই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পায় না। আমি বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কথা কখনই বলব না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিসিএস ডিপার্টমেন্ট খুললে কেমন হয়! যেখানে বিসিএস সিলেবাসের আওতাধীন স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করা যাবে। দীর্ঘ চার বছর বিসিএস–কেন্দ্রিক নার্সিং করা হলে তাঁদের বিসিএস ক্যাডার হওয়া আটকাবে কে!
বিভিন্ন বিভাগকেন্দ্রিক শিক্ষার্থীরা কী করবেন
সত্যি বলতে অনেকের বিভাগের পড়াশোনা ভালো লাগে না। শুধু একটা সনদের জন্য তাঁদের পড়াশোনা করতে বাধ্য করা হয়। কিছু কোর্স আছে, যা চাকরিবাজারে একদমই কাজে লাগে না। এগুলো পড়ে মাথায় চাপ বাড়িয়ে তো কোনো লাভ নেই। মনে করেন, একটা বিভাগের ১০০ জন শিক্ষার্থী। ১০০ জনকেই তো বিভাগের পড়াশোনা করার দরকার নেই। বিশেষায়িতকরণের মাধ্যমেই কিছু সুফল পাওয়া যেতে পারে। যেমন প্রায় ১০ জন টপারকে বিভাগকেন্দ্রিক পড়াশোনায় দক্ষ করে তোলা। তাঁদের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতার নিশ্চয়তা দান। তবে এ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা হলো দুর্নীতি। ৪০ জনকে বিসিএস–কেন্দ্রিক গাইডলাইন প্রদান। ২০ জনকে অনলাইননির্ভর কাজে দক্ষ হওয়ার সুযোগ দেওয়া। ৩০ জনকে বিভিন্ন করপোরেট জব ও বেসরকারি চাকরির জন্য দক্ষ করে তোলা। এসব বিভাজন করতে হবে শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী। যাতে মেধার স্বাক্ষর রেখে দক্ষ জনশক্তি ও মানবসম্পদে পরিণত হতে পারে।
সমাধান কী—
বাংলাদেশের এ বিশাল জনশক্তিকে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করার জন্য কিছু পন্থার মধ্যে অন্যতম হলো বাজারে যে ধরনের দক্ষতার চাহিদা রয়েছে, সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে যুগোপযোগী শিক্ষার ব্যবস্থা করা। এর মাধ্যমে বেকার সমস্যার সমাধান সম্ভব হতে পারে।
*লেখক: মো: এরশাদুল ইসলাম, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়