কলেজে উচ্চশিক্ষার নিয়ন্ত্রণ: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নাকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়?

প্রথশ আলো ফাইল ছবি

একসময় সরকারি, বেসরকারি কলেজের উচ্চশিক্ষা দেখভাল করত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। দেখা গেল তারা মূল ক্যাম্পাসের চাপ সামলে নিয়ে কলেজগুলোর পরীক্ষা নিয়মিত চালাতে পারেনি। ফলে শিক্ষার্থীদের ওপর সেশনজটের খড়্গ নেমে আসে। তারপর ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হলো। উদ্দেশ্য, কলেজ পরিচালনায় বিশৃঙ্খল অবস্থার নিরসন করে কলেজগুলোকে একই ছাতার নিচে আনা। যেন কলেজগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা না থাকে, তদুপরি শিক্ষার মান বৃদ্ধি পায়। প্রথম দিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এতগুলো কলেজের কর্মযজ্ঞ নিয়ে কিছুটা বেকায়দায় পড়ে ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়টি অবশ্য সেই চাপ সামলে নিয়েছে। কিন্তু এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে আড়াই যুগ পার হওয়ার পরও কলেজগুলোতে শিক্ষার মান মোটেও বাড়েনি। ফলে এখন আবার কলেজেগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিছু দিন পর যখন আবার বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবে, তখন হয়তো নতুন করে কলেজগুলোকে একটি একক কর্তৃপক্ষের নিয়েন্ত্রণে আনার সিদ্ধান্ত হবে। একটা দুষ্টুচক্রের অবতারণা হওয়ার অপেক্ষা!

সমস্যা হচ্ছে, সমস্যার গোড়ায় কেউ হাত দিচ্ছে না অথবা হয়তো গোড়াই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই ধরনের বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কী কী সমস্যা রয়েছে, এসব সমস্যা সমাধান করা যাচ্ছে না কেন এবং সমস্যা উত্তরণের জন্য সহজ ও বাস্তবায়নযোগ্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়ায় সুযোগ আছে, সেসব বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও সংশ্লিষ্ট সরকারি–বেসরকারি কলেজগুলোর কর্মকর্তা–শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা হতে হবে। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে যদি মনে হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে রেখেই কলেজগুলোতে উচ্চশিক্ষার মান বজায় রাখা সম্ভব, তবে এতগুলো কলেজকে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেওয়া নিরর্থক।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত হওয়ায় তাদের প্রতিটির আলাদা আলাদা স্বাতন্ত্র্যবোধ রয়েছে। অথচ সরকারি কলেজগুলোতে পাঠদানকারী শিক্ষক–কর্মকর্তাদের চাকরি বদলিযোগ্য। একজন শিক্ষক যখন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কোনো কলেজ থেকে বদলি হয়ে ভিন্ন কোনো পাবলিক বিশ্বিবিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কোনো কলেজে পদায়িত হবেন, তখন নতুন সিস্টেমে খাপ খাইয়ে নিতেই তাঁর গলদঘর্ম অবস্থার সৃষ্টি হবে। শিক্ষার মান তখন কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটা সহজেই অনুমেয়। তাছাড়া অভিযোগ আছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার যথেষ্ট ঘাটতি আছে। এখন যদি এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথায় নতুন কোনো বোঝা দেওয়া হয়, সেই বোঝা বহন করার সক্ষমতা তাদের আছে কি না, সেটা নিয়েও ভাবার অবকাশ আছে।

এবার আসল কথায় আসি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে উচ্চশিক্ষার মানে কেন ন্যূনতম মানদণ্ড বজায় রাখতে পারছে না, তার কতগুলো কারণ চিহ্নিত করা প্রয়োজন। যেমন—

১. কলেজ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি
২. অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র অনার্স কোর্স চালু
৩. সক্ষমতার তুলনায় অধিক শিক্ষার্থী ভর্তি
৪. শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করতে না পারা
৫. কলেজগুলোতে নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে তদারকি না করা।

এ সমস্যাগুলোকে একে একে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই কেবল কলেজগুলোতে উচ্চ শিক্ষার ন্যূনতম মান বজায় রাখা সম্ভব হবে। সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, সেসব বিষয়েও আলোচনা হতে পারে। এ ব্যাপারে আমার মনে হয় চার কাজ করা যেতে পারে—

১.

কলেজ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কী কী ধরনের সমন্বয়হীনতা রয়েছে, সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে সবার আগে। অনেক সময় দেখা যায় কলেজেগুলোতে ঠিকমতো ক্লাস হয়েছে কি না কিংবা নির্ধারিত কোর্স শেষ করতে যে সময় প্রয়োজন, শিক্ষার্থীরা সেই সময় পাচ্ছে কি না—এগুলোর খোঁজ না নিয়েই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার রুটিন দিয়ে দেয়। আবার কখনো কখনো সরকারি বন্ধের দিনেও পরীক্ষা থাকে। এসবই সমন্বয়হীনতার ফল। এই সমন্বয়হীনতা দূরীকরণের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ক্যাডার থেকে প্রেষণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মকর্তা নিয়োগ করা। তাঁরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর মধ্যে ব্রিজ হিসেবে কাজ করবেন। তখন একে অপরের সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে ওয়াকিবহাল থাকবে। আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরও সক্ষমতা বাড়বে।

২.

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিধারী উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার এখন ১২%। সংখ্যার বিচারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেকার বসে আছেন প্রায় আট লাখ নারী-পুরুষ। একদিকে দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষ জনবল বিদেশ থেকে আমদানি করছে, আর অন্যদিকে আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। সহজ কথায় বর্তমানে দেশের কর্মসংস্থানের সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো সামঞ্জস্য নেই। উল্লেখ্য বর্তমান সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে, সেখানে এগারোটি বিশেষ অগ্রাধিকারের কথা বলা আছে। এদের মধ্যে কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। কারিগরি শিক্ষার প্রসার না ঘটিয়ে যুবকদের এত বড় একটা অংশকে উৎপাদনমুখী কর্মে নিয়োজিত করা সম্ভব হবে না। যদিও সরকার প্রতিটি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ স্থাপন করছে, কিন্তু এটা দেশের চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়।

তাই দেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণ তথা জনমিতিকে (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) কাজে লাগানোর নিমিত্ত মূল ধারার শিক্ষাকে সীমিত করে কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। সেক্ষেত্রে উপজেলা পর্যায়ের কলেজগুলো থেকে অনার্স কোর্স বাদ দিয়ে সেখানে ধাপে ধাপে কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এসডিজি-৪–এর একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের সব পর্যায়ে সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। উপজেলা পর্যায়ের কলেজগুলোতে কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে পারলে তা এসডিজি-৪–এর লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়তা করবে। এতে দেশের দারিদ্র্যের হার কমবে, বর্তমান সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে। আবার একই সঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরও চাপ কমে যাবে।

৩.

জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ছোটো কলেজগুলো কারিগরি কলেজে রূপান্তরিত হলে সরকারের দুটি লাভ আছে। প্রথমত, দেশের বেকারত্বের হার কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, কারিগরি শিক্ষা চালু করায় সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ হবে বিসিএস নন ক্যাডার থেকে। বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার হতে নিয়োগের আর প্রয়োজন হবে না। অনার্স কোর্সের পরিবর্তে নির্দিষ্ট কতগুলো কারিগরি ট্রেড চালু হলে সেসব কলেজগুলোতে শিক্ষকের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে যাবে। এতে কলেজেগুলো যেমন বিসিএস পাস মেধাবী শিক্ষক পাবে, অন্যদিকে সরকারের আর্থিক ব্যয়ও কিছুটা কমে যাবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তখন কলেজগুলোতে যেসব শিক্ষক পাঠদান করছেন, তাঁদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে? সেক্ষেত্রে সহজ সমাধান হচ্ছে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে হবে ধাপে ধাপে। সরকারি কলেজে কর্মরত বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের সদস্যদের ধীরে ধীরে বিভাগ ও জেলার কলেজগুলোতে বদলি করতে হবে। আর বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা অবসরে যাওয়ার পর সেখানে নতুন করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রভাষক নিয়োগ না দিয়ে কারিগরিতে পাঠদানকারী শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। এভাবে কলেজগুলো ধীরে ধীরে সাধারণ কলেজ থেকে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।

৪.

দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের সম্পৃক্ত করে একটা কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এ কমিটি বর্তমানে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের কলেজের সংখ্যা, কোন বিষয়ে কোথায় অনার্স কোর্স চালু আছে, কলেজগুলোতে শিক্ষক কর্মকর্তার সংখ্যা, অনার্স পর্যায়ে শিক্ষার্থীর মোট সংখ্যা ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ করবে। তারপর কলেজগুলোর সক্ষমতার আলোকে অনার্স কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তির হার নির্ধারণ করে দেবে। যেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজগুলো অতিরিক্ত আয়ের আশায় প্রয়োজনের তুলনায় অধিক শিক্ষার্থী ভর্তি করতে না পারে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর কিছু প্রস্তাবও সেই কমিটি দিতে পারে।

মাথাব্যথা হলে মাথা না কেটে যেমন ব্যথা কমানোর ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়, ঠিক তেমনি উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে কলেজগুলোগুলোকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে না সরিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতিতেই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও অতিরিক্ত ভার থেকে মুক্ত রাখতে হবে, যেন সেখানকার শিক্ষকেরা নিজেদের গবেষণামূলক কাজে ব্যস্ত রাখতে পারেন। তাহলেই কেবল একদিকে উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়ন হবে, আবার অন্য দিকে কারিগরি শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে সুখী–সমৃদ্ধ স্মার্ট সোনার বাংলা তৈরি হবে।

লেখক: শফিক ইসলাম, প্রভাষক, গণিত বিভাগ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজ, গাজীপুর।

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]