ছোটবেলার বড়দিন

সখীদের নাচছবি: লেখকের পাঠানো

ডিসেম্বরের শুরু থেকে শীত পড়ে যায়, কয়েকটা দিন গেলে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। আর পরীক্ষা শেষ মানেই বড়দিনের প্রস্তুতি শুরু! আজ বারান্দায় বসে সেই ছোটবেলার বড়দিন খুঁজতে গিয়ে মোহময়তায় হারিয়ে যাচ্ছি—কীর্তনে সখীদের ঘুঙুরের আওয়াজ, ২৫ ডিসেম্বর গির্জায় যাব বলে যত্ন করে রাখা নতুন পোশাক, বাড়িঘর সাজানোর ধুম, কেক-পিঠার মমতামাখা গন্ধ, বিদেশ ও শহর থেকে দীর্ঘদিন পরে গ্রামে ফিরে আসা প্রিয় মুখগুলো আর শীতের হিম হিম কুয়াশার আয়োজন—সব যেন ডাকছে আমায়। ওই দূরের আবছায়া, কুয়াশাময়; আবার কখনো সামনে এসে দাঁড়ায়—যেন হাত বাড়ালে ছোঁয়া যায় আমার শৈশব।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে গ্রামের বড় দাদারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কীর্তনের রিহার্সালের খবর দিতেন। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হতো কীর্তনের রিহার্সাল বা মহড়া। শীতের সন্ধ্যায় আমরা ছোট ছোট ছেলেরা যেতাম কীর্তনের প্রস্তুতি নিতে। ছোটবেলায় মা-বাবা ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়ার প্রথম সুযোগ হয় এই কীর্তনের সময়টাতে। আমি যখন কীর্তন করতাম, তখন আমাদের মোলাশীকান্দা গ্রামে কোনো ক্লাবঘর ছিল না। আমরা গ্রামের একটি বাড়িতে প্রায় পুরো মাস এই কীর্তন নিয়ে হইচই করে কাটিয়ে দিতাম। রিহার্সাল শুরুর প্রথম দিনগুলোয় গান শেখানো হয়। পুণ্য রাত্রি চলেছে যাত্রী/ মহা আড়ম্বরে/ জীর্ণ গোশাল ঘরে/ পঁচিশে ডিসেম্বরে অথবা একটি তারার ইশারায়/ চলো মোরা ছুটে যাই/ বেথেলের ওই গোশালায়—এ রকম কত গান ছোটবেলায় শিখেছি। গীতিকবিতাগুলো গ্রামের শিল্পী-কবিরা কীর্তনের জন্য লিখে এবং তাতে সুর বসিয়ে গান তৈরি করে। গান শেখার পর তাল শেখানো হয়—এক তাল ও দুই তাল। এক পা দিয়ে এক তাল আর দুই পা দিয়ে দুই তাল দিতে হয়, সেই সঙ্গে কোমর দোলাতে হয়। কেউ কেউ এই তাল না পারার কারণে কীর্তনে সখী হতে পারত না। তারপর দেখানো হয় নাচের আর্ট। বড় দাদারা নাচের মুদ্রা বা আর্ট শেখাতেন।  

কাঠি নাচ
ছবি: লেখকের পাঠানো

দেশের সব এলাকায় ঢোল-খোল নিয়ে সবাই গোল হয়ে কীর্তন করে থাকে। শুধু ঢাকার নবাবগঞ্জ-দোহার জনপদের খ্রিষ্টান গ্রামগুলোয় বড়দিনে এই সখী কীর্তন হয়। তাই দেশের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের কাছে আঠারোগ্রাম নামে খ্যাত এ অঞ্চলের কীর্তন আঠারোগ্রামের কীর্তন নামে পরিচিত। কীর্তনে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সখী সাজানো হয়। শাড়ি ভাঁজ দিয়ে কোমরে ফিতা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়; তারপর কোমরে মাফলার বাঁধা হয়। মাথায় মুকুট, পায়ে ঘুঙুর আর মুখে গাঢ় সাদা প্রসাধনী দিয়ে ছেলেমেয়েদের সাজানো হয়। তারপর মুখে লাল-নীল-হলুদ রঙের নকশা আঁকা হয় সরু কাঠি দিয়ে। ডিসেম্বরের শেষ দিকে বেশ শীত থাকে। শীতের সকালে অনেক কষ্টে বিছানা ছেড়ে চলে যেতাম সাজতে—সকালে সাজানো হতো, সারা দিন এই সাজ নিয়ে থাকতে হতো। সপ্তাহজুড়ে হাসনাবাদ, গোল্লা ও তুইতাল ধর্মপল্লির গ্রামগুলোয় কীর্তন করতাম। আমি যখন প্রথম কীর্তনে সখী হই, তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তাম। ওই বয়সে এত হাঁটতে পারতাম না। একজন বড় দাদা আদর করে আমাকে কাঁধে করে নিয়ে হাঁটতেন। কীর্তনে দুজন লিডম্যান থাকে, তাদের কাছে সব সময় বাঁশি থাকে। আমরা সেই বাঁশিওয়ালার পিছু পিছু হাঁটতাম। বাড়ি বাড়ি কীর্তন করে টাকা ভালোই জমত। হারমোনি, তবলা আর সখীদের ঘুঙুরের শব্দে কখন যে দিন থেকে রাত হতো, তার খেয়াল কে রাখে! ২৫ ডিসেম্বর বিকেল থেকে টানা এক সপ্তাহ কীর্তন চলত। আমাদের পকেটে থাকত কাটাকলি পিঠা এবং বান্দুরা বাজারের লরেন্স বেকারির কেক।

সাজানোর সময়
ছবি: লেখকের পাঠানো

সখী নৃত্য ছাড়াও আমাদের মোলাশীকান্দা উদ্যোগী সংঘের কীর্তন কাঠিনাচের জন্য বিখ্যাত। দুই হাতে দুটি কাঠি নিয়ে হারমোনি ও তবলার তালে তালে এই নাচ পরিবেশন করা হয়। আটজনের দলে একজনের মুখে বাঁশি থাকে। তিনি নাচের সময় বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। একই রকম কাঠির শব্দ, সেই সঙ্গে নাচের অপূর্ব কৌশল মুগ্ধ হয়ে মানুষ উপভোগ করে। যখন কীর্তনে সখী ছিলাম, এই কাঠি নাচ বিস্ময়কর মনে হতো। সখী বয়স পার করে আমিও কাঠিনাচ দলে নেচেছি জীবনের রঙিন দিনগুলোয়।

কীর্তনের সখী
ছবি: লেখকের পাঠানো

সেই সময় গেছে চলে, এখন বড়বেলার বড়দিন। বড় হতে হতে কি আনন্দ ছোট হতে থাকে? জানি না, তবে সখী কীর্তন বড়দিনের সময়টাতে পরম্পরায় প্রতিবছর হয়ে থাকে। তাই আজকের সখীদের আনন্দ আর হইহুল্লোড়ের দিকে তাকিয়ে আমি আমার শৈশবকে ছুঁয়ে দেখার এক অপার্থিব উল্লাস খুঁজে ফিরি।  

লেখক: জেমস আনজুস, মোলাশীকান্দা; হাসনাবাদ, নবাবগঞ্জ, ঢাকা