কৃষ্ণচূড়া, জারুল, বকুল, বেলির ঘ্রাণে বেড়ে উঠুক আগামী প্রজন্ম

শিক্ষা গ্রহণ এবং বৃক্ষরোপণ সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গঠনে দুটি সেরা বিনিয়োগ। তাই শিক্ষা গ্রহণ ও বৃক্ষরোপণ—এ দুই কাজকে একত্র করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গাছ লাগানোর চেয়ে ভালো উদ্যোগ আর কী হতে পারে! বিদ্যালয়, উদ্যান ও বাড়িতে গাছগাছালির উপস্থিতি শিশুদের বিকাশ, শেখা ও ফোকাস করতে সহায়তা করে এবং মনোযোগের ঘাটতি ও হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডারের লক্ষণগুলো কমাতে পারে। সবুজ পরিবেশ বিদ্যালয়ের কর্মক্ষমতা উন্নত করতে পারে। গাছ আমাদের বাড়ি, গ্রাম, বিদ্যালয় ও সম্প্রদায়ের পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধার একটি সম্পদ প্রদান করে। গাছ–বন বায়ু ও জলের গুণমান মান উন্নত করে, কার্বন ডাই–অক্সাইডকে আলাদা করে, ঝড়, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ কমায়, আমাদের চারপাশকে ছায়া দেয় ও শীতল করে, অক্সিজেন তৈরি করে, বন্য প্রাণীদের জন্য বাসস্থান সরবরাহ করে, সম্পত্তির মান বৃদ্ধি করে এবং মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করে।

শিশু ও যুবকদের প্রকৃতির সঙ্গে, বিশেষ করে গাছ ও বনের সংযোগ থেকে সবচেয়ে বেশি লাভ হয়।

ইলিনয় ইউনিভার্সিটির গবেষণায় দেখা গেছে, অল্প বয়সী মেয়েরা, যারা সবুজ পরিবেশে বড় হয়েছে, তারা ভালো ফল দেখিয়েছে, কম আবেগপ্রবণ আচরণ প্রদর্শন করেছে, উচ্চতর স্বশৃঙ্খলা ছিল এবং সহকর্মীদের চাপ সামলাতে সক্ষম হয়েছিল। স্কুলে প্রকৃতির দৃষ্টিভঙ্গিসহ মধ্যবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুর্ব্যবহার, বন্ধুত্বহীনতার অনুভূতি এবং অনুপস্থিতির হ্রাস দেখিয়েছে। পাবলিক হাইস্কুলের ছাত্রদের ওপর করা একটি সমীক্ষায় প্রকৃতির দৃষ্টিভঙ্গি থাকাকালে ছাত্রদের আচরণ ও কর্মক্ষমতায় ধারাবাহিক উন্নতি পাওয়া গেছে। প্রকৃতির উপস্থিতি (এমনকি শুধু দৃশ্য) ছাত্রদের মানসিক ক্লান্তি ও চাপ থেকে পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করে।

শিক্ষার্থীরা বৃক্ষরোপণের প্রক্রিয়ার প্রায় প্রতিটি অংশের সঙ্গে জড়িত হতে পারে, যা শুধু গাছের বৃদ্ধির জন্যই সহায়ক নয়, শিশুদের জন্যও উপকারী। এমন একটি সময়ে যখন অনেক শিশু বাইরে খুব কম সময় কাটায়, শারীরিকভাবে সক্রিয় নয় এবং তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন, বৃক্ষরোপণ তাদের শরীর ও মন উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। গাছের পরিচর্যায় সময় ব্যয় করা শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কর্মক্ষমতা, মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা, একাগ্রতা এবং স্বশৃঙ্খলার পাশাপাশি প্রকৃতির প্রতি তাদের ভালোবাসা বাড়ায়।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লার্নিং উইফ ট্রিস কার্যক্রম রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ‘ট্রি ট্রাস্ট’স লার্নিং উইথ ট্রিজ’ প্রোগ্রাম হলো যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা শহরের প্রাথমিক এবং মধ্যবিদ্যালয়ের জন্য ফাউন্ডেশন অনুদান এবং করপোরেট স্পনসরশিপের অর্থায়নে করা বিনা মূল্যের একটি প্রোগ্রাম। স্কুলগুলো এ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য সারা বছর আবেদন করতে পারে; স্কুল নির্বাচন ভৌগোলিক অবস্থান এবং স্পনসরশিপের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে। এই প্রোগ্রামে শিশুদের বৃক্ষরোপণ, পরিচর্চা ও বৃক্ষপাঠ শেখানো হয়।

সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলায় মোট ২৩৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুই হাজারের বেশি গাছ লাগানো হয়েছে। এখানে কমবেশি ২৫ হাজার শিশু অংশগ্রহণ করছে। প্রতিটি শিশুকে বিদ্যালয়ে আকৃষ্ট করতে চাই বিদ্যালয়ে শোভাবর্ধন। আর এ শোভাবর্ধনে কাজীপুর উপজেলার সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শোভাবর্ধক গাছ লাগানোর উদ্যোগ আগামী প্রজন্মকে উদ্ভিদপ্রেমী করবে, এটা নিশ্চিত। প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি করে কৃষ্ণচূড়া, জারুল, সোনালু, পলাশ, নিমগাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ফুলের বাগান তৈরির জন্য একটি করে বকুল, বেলি, গন্ধরাজগাছ বাগানে রোপণ করা হয়েছে। লাল কৃষ্ণচূড়া আর পলাশ, বেগুনি জারুল আর হলুদ সোনালুর শোভায় শিশুরা বিদ্যালয়ে দৌড়ে এসে বেলি, গন্ধরাজ ও বকুলের ঘ্রাণে পাঠ গ্রহণ করবে। পুলকিত মনে বিকশিত হবে আগামী প্রজন্ম। সেই সঙ্গে এই উদ্যোগকে টেকসই করতে গাছের স্বাস্থ্যতথ্য (হেলথ কার্ড) দেওয়া হয়েছে। হেলথ কার্ডে সংযোজন করা হয়েছে অনেকগুলো গাছ পরিচর্চার ধাপ, যেমন আগের দিন পরিমাণমতো গর্ত করা ও গর্তে প্রয়োজনীয় গোবর সার দেওয়া, ১ দিন পর গাছ লাগানো, বেড়া দেওয়া (ফেন্সিং), খুঁটি দেওয়া, ১৫ দিন সকাল–বিকেল পানি দেওয়া, ৩ মাস পর পর্যবেক্ষণ, ৬ মাস পর পর্যবেক্ষণ, ১ বছর পর পর্যবেক্ষণ এবং ৪ বছর পর পর্যবেক্ষণ। এ ধাপগুলো খুদে শিক্ষার্থীদের গাছের সঙ্গে মানসিক ও আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করবে। সেই সঙ্গে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় এসব গাছের ছায়া ও ফুলের ঘ্রাণে বেড়ে উঠবে আগামী প্রজন্ম।

লেখক: উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কাজীপুর, সিরাজগঞ্জ এবং যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স থেকে গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন অ্যান্ড লজিস্টিকস ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর