আমাদের শতরঞ্জিশিল্পের সাতকাহন
আমাদের শতরঞ্জিশিল্পের ইতিহাস ৭০০ বছরের প্রাচীন ও সমৃদ্ধ।
চিরায়ত বাংলার নয়নাভিরাম নকশার শতরঞ্জির নান্দনিকতা এখন আধুনিক বাংলাদেশে, এমনকি বিদেশেও সমাদৃত হচ্ছে। জানা যায়, রংপুর জেলার তাঁতিরা ৭০০ বছর আগে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে একধরনের মোটা কাপড় তৈরি করতেন, যা শতরঞ্জি নামে পরিচিত। শতরঞ্জি বা ডুরি মূলত একপ্রকার কার্পেট। একসময় সমাজের অভিজাত শ্রেণির গৃহে, বাংলো বাড়িতে বা খাজাঞ্চিখানায় বিশেষ আসন হিসেবে শতরঞ্জি ব্যবহৃত হতো। বর্তমান আধুনিক সমাজে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে এখনো ব্যবহার হওয়া শতরঞ্জি তার নিজস্ব আবেদন ক্রমশ বাড়িয়ে যাচ্ছে। শতরঞ্জি ফার্সি ভাষার শব্দ শতরঞ্জ থেকে এসেছে। দাবা খেলার ছককে শতরঞ্জ বলা হয় এবং দাবা খেলার ছকের সঙ্গে শতরঞ্জির নকশার মিল থাকার কারণে এটাকে শতরঞ্জি নামে নামকরণ করা হয়।
শতরঞ্জিশিল্পের প্রাচীন ইতিহাস ও রংপুর জেলা
বাংলাদেশের উত্তর জনপদের প্রাচীনতম জেলা রংপুর। প্রাচীন নিদর্শনাদি ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলিতে সমৃদ্ধ এ জেলা খুবই উল্লেখযোগ্য। রাজধানী ঢাকা থেকে রংপুরের দূরত্ব ৩৩৫ কিলোমিটার। রংপর জেলা শহর থেকে পশ্চিমে সেনানিবাসের পেছনে ঘাঘট নদীর কোল ঘেঁষে বিশাল এক গ্রামের নাম নিসবেতগঞ্জ। গ্রামটির কিছু মানুষ ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে পাটের সুতার শতরঞ্জি বানানো শুরু করেন। পরে ব্রিটিশ আমলে ওই গ্রামের একটি পাড়ার নামই হয়ে যায় শতরঞ্জিপাড়া। নিসবেতগঞ্জ গ্রামের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে রংপুরের অন্য এলাকায়ও অনেকে শতরঞ্জি তৈরিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
শতরঞ্জি, ঐতিহ্যের বস্ত্রশিল্পের কারুপণ্য
স্মরণাতীতকাল থেকে বাংলাদেশ কারুশিল্পের জন্য গর্ব বোধ করে আসছে। গ্রামের শিল্পী ও কারিগরেরা তাঁদের চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশের নানা উপকরণ দিয়ে দৈনন্দিন জীবনে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে যে বস্তু, শিল্প ও শিল্পকর্ম গড়েন, তার মধ্যে ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প হলো বস্ত্রশিল্প। বাংলাদেশকে বস্ত্রায়ন শিল্পের জন্মভূমি বলা হয়ে থাকে। বস্ত্রশিল্পের কারুপণ্য শতরঞ্জি শুধু রংপুরের ঐতিহ্য নয়, এটি বাংলাদেশেরও ঐতিহ্য বহনকারী অন্যতম কারুপণ্য।
অভিজাত অন্দরমহলের জন্য নান্দনিক শিল্পপণ্য হিসেবে শতরঞ্জি
শতরঞ্জি বাড়ায় ঘরের শোভা। শতরঞ্জি আগে শুধু ঘরের মেঝেতে বিছানোর জন্যই তৈরি হতো। সময়ের বিবর্তনে একই বুননে শতরঞ্জির ওয়ালম্যাট, টেবিলম্যাট, কুশন কভার, সোফার রুমাল, জায়নামাজ, পাপোশও তৈরি হচ্ছে। শতরঞ্জিতে বিভিন্ন রঙের সমন্বয় ঘটিয়ে ডিজাইন করা হয়। নামের প্রকারভেদ অনুযায়ী কোনটার জন্য কী নকশা ও রং ব্যবহার করা হবে, তা আগে থেকেই পরিকল্পনা করা হয়।
ঢাকা শহরে শতরঞ্জির বাজারভিত্তিক চিত্র
দেখা গেছে, ৬ থেকে ৯টি রঙের ৪০-৫০টি ডিজাইনের শতরঞ্জি বাজারে পাওয়া যায়। পাশাপাশি ইচ্ছা অনুযায়ী নতুন করে বা নিজের পছন্দের নকশা অনুযায়ী ফল, ফুল, কার্টুনের পায়ের ছাপ—এসব আকারের শতরঞ্জিও পাবেন। শতরঞ্জির দাম নির্ধারণ করা হয় বর্গফুট হিসাবে। প্রতি বর্গফুট ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হয়। রংপুরে রয়েছে শতরঞ্জির প্রায় ৩০টি দোকান। শতরঞ্জি পাওয়া যাবে ঢাকার শুক্রাবাদ, নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড, রাজধানী সুপার মার্কেট, গুলশান-২ ডিসিসি মার্কেট, গুলশান-১ নম্বরে। ফ্যাশন হাউস আড়ং ও যাত্রাতেও পাওয়া যাবে সুতা ও মখমলের তৈরি শতরঞ্জি।
ব্রিটিশ আমল ও প্রাচীনকালে শতরঞ্জি
মালুদা নামক জিনিস থেকে তাঁতজাতীয় যন্ত্রের মাধ্যমে মোটা সুতি কাপড় ও উলের সুতা ব্যবহার করে একপ্রকার পাটিজাতীয় সামগ্রী তৈরি শুরু করেন কারিগরেরা। মালুদা তৈরিতে কারিগরদের মননশীল কারুকাজের উপজীব্য বিষয় ছিল গ্রামবাংলার চিরায়ত শৈল্পিক আবহ। নান্দনিক এ শিল্পকর্ম উপমহাদেশের সে সময়কার রাজা-বাদশাহদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়, যা কালক্রমে ভারতীয় উপমহাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও বিস্তৃতি লাভ করে। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে নিসবেত নামের একজন ব্রিটিশ রংপুর জেলার কালেক্টর ছিলেন। তিনি রংপুরের পীরজাদা গ্রামের শতরঞ্জিশিল্প দেখে মুগ্ধ হন এবং পরবর্তী সময়ে এর গুণগত মান উন্নয়ন ও এ শিল্পের সম্প্রসারণে সার্বিক সহায়তা প্রদান করেন। জনশ্রুতি রয়েছে, তাঁর নামানুসারেই তৎকালীন পীরজাদাবাদ মৌজার একাংশকে নিসবেতগঞ্জ নামকরণ করা হয়। জানা যায়, সম্রাট আকবরের দরবারেও দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিক ডিজাইনের এই মালুদার ব্যবহার ছিল। পরবর্তী সময়ে জেলার কালেক্টর ব্রিটিশ কর্মকর্তা এই শিল্পকে বেগবান করার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
বিবি রাসেল ইউরোপে শতরঞ্জির প্রমোটর
ঢাকায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের খ্যাতিসম্পন্ন ফ্যাশন ডিজাইনার ও মডেল বিবি রাসেলের উদ্যোগে ইউরোপিয়ান কমিশনের মাধ্যমে ইউরোপের বাজারে রংপুরের শতরঞ্জির নুতন পরিচয় ঘটে। এর ধারাবাহিকতায় শতরঞ্জি ইউরোপসহ পাশ্চাত্য দুনিয়ায় খ্যাতি লাভ করে আসছে।
এই শিল্পের আধুনিকায়নে একজন সফিকুল ইসলাম সেলিমের অনবদ্য ভূমিকা
শতরঞ্জিপল্লিতে গেলে দেখা যাবে, শতরঞ্জি বুননে ব্যস্ত আছেন নারী-পুরুষ। জানা যায়, ১৯৯১ সালে নিসবেতগঞ্জ গ্রামে বিসিকের বন্ধ থাকা একটি দোচালা ছোট্ট কারখানা ভাড়া নিয়ে ঝিমিয়ে পড়া শতরঞ্জিশিল্পকে জাগিয়ে তুলতে উদ্যোগ নেন রংপুরের কারুপণ্যের স্বত্বাধিকারী জনাব সেলিম। তিনি তাঁর কারখানায় শতরঞ্জি বানিয়ে দেশের বিভিন্ন শিল্প ও বাণিজ্য মেলায় স্টল দিয়ে ব্যাপক পরিচিতি ও ক্রেতাদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন। এভাবে বাড়তে থাকে শতরঞ্জির চাহিদা। পরবর্তী সময়ে ঢাকায় ‘শতরঞ্জি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন তিনি। আর এখন সেখানে কারুপণ্যের উৎপাদন ছাড়াও স্থানীয় ছোট ছোট মহাজনের নিজস্ব অর্থায়নে পল্লির প্রায় ২০০ পরিবার এ পেশার জড়িত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। চাহিদা বৃদ্ধির সুবাদে কারুপণ্যের উদ্যোগে রংপুর শহরের রবার্টসনগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও জেলা সদর, কুড়িগ্রাম এবং উলিপুর পৌর এলাকায়ও গড়ে উঠেছে শতরঞ্জিকেন্দ্র। প্রতিদিন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শত শত পিস শতরঞ্জি উৎপাদন করা হচ্ছে। তথ্যের আলোকে দেখা গেছে, বাংলাদেশে হস্তশিল্প থেকে রপ্তানি আয়ের শতকরা ৬০ ভাগের অবদান কারুপণ্য রংপুর লিমিটেডের। অসাধারণ এ কাজের জন্য ২০১০ সালে সরকারি পর্যায়ে জাতীয় রপ্তানি ট্রফির স্বর্ণপদকের পুরস্কার পান কারুপণ্যের স্বত্বাধিকারী সফিকুল আলম সেলিম।
রপ্তানিপণ্য হিসেবে শতরঞ্জির সাফল্য ও পেশাসংশ্লিষ্টদের জীবনমানের অবস্থা
নান্দনিক এই শিল্পকর্ম উপমহাদেশের সে সময়কার রাজা-বাদশাহদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়, যা কালক্রমে ভারতীয় উপমহাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও বিস্তৃতি লাভ করে। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে নিসবেত নামের একজন ব্রিটিশ রংপুর জেলার কালেক্টর ছিলেন। তিনি রংপুরের পীরজাদা গ্রামের শতরঞ্জিশিল্প দেখে মুগ্ধ হন এবং পরবর্তী সময়ে এর গুণগত মান উন্নয়ন ও এ শিল্পের সম্প্রসারণে সার্বিক সহায়তা প্রদান করেন। জনশ্রুতি রয়েছে, তাঁর নামানুসারেই তৎকালীন পীরজাদাবাদ মৌজার একাংশকে নিসবেতগঞ্জ নামকরণ করা হয়। জানা যায়, সম্রাট আকবরের দরবারেও দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিক ডিজাইনের এই মালুদার ব্যবহার ছিল। পরবর্তী সময়ে জেলার কালেক্টর ব্রিটিশ কর্মকর্তা এই শিল্পকে বেগবান করার জন্য গ্রামটির নামকরণ করেন নিসবেতগঞ্জ। কালের বিবর্তনে সেই মালুদা শতরঞ্জি নাম ধারণ করে। ১৯৭৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সা’দত মোহাম্মদ সায়েমের নির্দেশে প্রথম সরকারিভাবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) মাধ্যমে নিসবেতগঞ্জ গ্রামে শতরঞ্জি তৈরির প্রকল্প গ্রহণ করে। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৫ সালে প্রথম সরকারিভাবে বিসিক শতরঞ্জিশিল্পে জড়িত ৪৫ জন শ্রমিককে কারিগরি শিক্ষা প্রদান করা হয়। এর পর থেকে অবহেলিত শতরঞ্জিশিল্প সরকারের দৃষ্টিতে আসেনি। বলা যায় অবহেলার শিকার হয়ে বিলুপ্ত হতে যাওয়া শিল্পটির প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা। তারপরও নানা প্রতিকূলতায় এ পেশার সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। তবে বিসিকের উদ্যোগে এ শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে ঢাকার এক ব্যবসায়ী বিসিকের এ কেন্দ্রটি লিজ নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেন। পরে রংপুর শহরের কারুপণ্যের মালিক সেলিমের আন্তরিক প্রচেষ্টায় শতরঞ্জির ব্যবহার আরও বহুমুখী হয়ে ওঠে।
শতরঞ্জির বিকাশে কিছু প্রতিবন্ধকতা ও শেষ কথা
এই শিল্পের প্রয়োজন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, ইউরোপের দেশগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী শতরঞ্জি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। কারণ, শিল্প এলাকায় অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, কারিগরি জ্ঞানের অভাব ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় তাঁরা শতরঞ্জি কারখানা গড়ে তুলতে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। সরকারি সহযোগিতা পাওয়া গেলে দেশের কাঁচামাল দিয়ে এই শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে দেশীয় শিল্পের ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখবে শতরঞ্জিশিল্প।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট